হালিশহরে একদিনের ভ্রমণ
হালিশহর
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় ।
এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলতো সোনা। রামপ্রসাদ সেনের এই গানটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে । মনে মনে ভাবি একই জমিতে এত বছর কেটে গেলো (রামপ্রসাদের ভিটের জমিতে) অথচ কোনদিনই আমি লিখতে পারলাম না হালিশহরকে নিয়ে । আয় মন বেড়াতে যাবি । এই শ্যামা সংগীত শুনে শুনে বড় হয়েছি । দেশ বিদেশ নিয়ে নানান লেখা লিখেছি । জন্ম ভিটে বড় সুন্দর ভ্রমণের জায়গা তাকে নিয়ে লিখলাম না কেন ? সেই প্রশ্ন মাঝে মাঝে আমায় ভাবায় ।
রামপ্রসাদ কালীবাড়ি॥ ছবি তাপস কুমার দত্তগঙ্গা নদীর একটা গুণ আছে সে যে পথ দিয়ে গেছে তার চারিপাশে যেমন শিল্প তৈরি করেছে তেমনি শিল্পীও তৈরি করে গেছেন । একেই বলে মাটির গুণ । বহু বঙ্গচর্চিত মানুষের বাস ছিলো এই ছোট অঞ্চলে । রামপ্রসাদ সেন , রাণীরাসমণি , নিগমানন্দ পরমহংস , মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের দীক্ষাগুরু ঈশ্বরপুরী থেকে কবিকর্ণপুর পরমানন্দ সেন , আজু গোঁসাই ।
আমি যেখানে থাকি সেই রাস্তার নাম শিবের গলি, চৌধুরিপাড়া। একদিকে মিথ শিব , অন্যদিকে সাবর্ণচৌধুরির ইতিহাস । সাবর্ণচৌধুরিরা তো হালিশহরের মানুষ । তাঁদের সপ্তম দোল এখনো এখানে হয়ে চলেছে ।শিবের গলি শুধু মন্দির ময় ।
হালিশহরকে বলা হয় শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মিলন ক্ষেত্র । বিভিন্ন বইপত্রে এমনি লেখা আর শুনেও আসছি সেই ছোটবেলা থেকে । আজু গোঁসাই আর আর রামপ্রসাদ সেনের লড়াই । আসলের লড়াইটা শুরু বহু আগে থেকেই ।বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পালদের পরে গোঁড়া শৈব মতাবলম্বী সেনরা রাজত্ব চালান।প্রবল কৌলিন্য প্রথার মধ্যে দিয়ে চলা হালিশহরের সংস্কৃতিতে ধর্মান্ধতার গ্লানি যখন চেপে বসেছে, তখন বৈষ্ণব ধর্মের পথিকৃৎ চৈতন্যদেবের দীক্ষা গুরু শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর উত্থান হয়। এই শহরেই তাঁর জন্মভিটেতে এখন রাজ্যের অন্যতম বড় বৈষ্ণব পাঠাগার। চৈতন্যদেবের পদধূলি হালিশহরের বুক জুড়ে। চৈতন্যদেব গুরুর সাথে ভ্রমণে যাবার আগে দেখা করতে এলেন । গুরু কে না পেয়ে গুরু বাড়ি থেকে একমুঠো মাটি নিয়ে গেলেন ভক্তরা মাটি নিয়ে নিয়ে ডোবা বানিয়ে ফেললেন । সেই থেকে চৈতন্যদেবডোবা ।
চৈতন্যদেব ডোবা ॥ ছবি তাপস কুমার দত্তহালিশহরে সাধক রামপ্রসাদ সেনের ভিটে। কবি রামপ্রসাদ সেন ১৭২০ সালে এই শহরে জন্মগ্রহণ করেন।৩০০ বছর আগে তিনি যে গান রচনা করে গেছেন তা আজও আধুনিক এবং সময় উপযোগী । বাবার মৃত্যুর পর কেরানির কাজ নিয়েছিলেন প্রসাদ। কিন্তু হিসেবের খাতাতেই গান লিখে রাখতেন। ঊর্ধ্বতনরা অসন্তুষ্ট হতেন। শেষমেশ মনিবের কানে যেতে তিনি খাতা দেখলেন। গানের ভাব ও ভাষায় মোহিত হলেন। রামপ্রসাদকে সেই সময় বিনা কাজেই তিরিশ টাকা মাসোহারার বন্দোবস্ত করেছিলেন। পরে নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রও গঙ্গাবক্ষে রামপ্রসাদের গান শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হন। তিনি সভায় আহ্বান জানান। কিন্তু প্রসাদ রাজার অনুরোধ রাখতে পারেননি। তা সত্ত্বেও রাজা তাঁকে নিষ্কর একশো বিঘা জমি দান করেছিলেন। পুরস্কার হিসেবে রাজাকে বিদ্যাসুন্দর কাব্য লিখে উপহার দিয়েছিলেন রামপ্রসাদ। যদিও তা ভাষায়-ভাবে-অলংকারে ভারতচন্দ্রের কাব্যের সমতুল নয়। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দর অনেক রসে বসে ছিল ।সেই রামপ্রসাদের বাড়ি আর পঞ্চবটি আজও মানুষ দেখতে আসেন বিভিন্ন জায়গা থেকে । রামপ্রসাদের ভিটেতে কালীবাড়ির জন্যই হালিশহর একটি সিদ্ধপীঠ। এমনকি রানি রাসমণির জন্মস্থান এই হালিশহর। তাঁর পৈতৃক বাড়ি, বাঁধানো ঘাট এখনও আছে।
নিগমানন্দ আশ্রম ॥ ছবি লেখক
শাক্ত বৈষ্ণবদের মিলন ঘটিয়েছিলেন আর একজন মহাপুরুষ তিনি স্বামী নিগমানন্দ । অদ্বৈতবাদ ও অখন্ড অদ্বৈতবাদকে তিনি এক জায়গায় এনে বসিয়ে দিয়েছেন । শঙ্করাচার্য আর রামানুজ যেনো এক জায়গায় ।
শঙ্করের মত অর্থাৎ জ্ঞানের পথ আর গৌরাঙ্গের পথ ভক্তি ।
নিগমানন্দ ছিলেন ভারতের একজন সদগুরুও সাধু। পূর্ব ভারতে সুপরিচিত একজন হিন্দু যোগী ও আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি ছিলেন হিন্দু গুরু, দার্শনিক তন্ত্র ও যোগের একজন উত্কৃষ্ট আধ্যাত্মিক নেতা। তাঁর বিখ্যাত মঠটি ও রয়েছে হালিশহরের গঙ্গার তীরে ।
ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে এক আফগান সম্রাটের হাতে প্রতিষ্ঠা পেল ‘হাভেলি শহর’। ইচ্ছাপুরের খালের এপাশ থেকে কাঞ্চনপল্লী ছিলো হাবেলি পরগনা । হাভেলি শহর অর্থাৎ অট্টালিকা বহুল নগরী, কথাটির অপভ্রংশে এসেছে হালিশহর নাম। এই শহরের প্রাচীন নাম কুমারহট্ট। একসময় এখানে কুমোরদের বসত ছিলো, হাট বসত বলেই কুমারহট্ট। গঙ্গার ঘাট থেকে চালান হত মাটির তৈরি হাঁড়ি, কলসি। সেই কুমারহাট থেকেই নাম হল কুমারহট্ট।ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের পুঁথিচর্চার ফলে এখানকার পণ্ডিত সমাজ একসময় নবদ্বীপের সমতুল্য খ্যাতি অর্জন করেছিল। আমাদের ছোট বেলায় অনেক টোলও দেখছি ।
বারেন্দ্র গলির মন্দির ছবি লেখককবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখায় পাওয়া যায় হালিশহর নামটি- “বামদিকে হালিশহর দক্ষিণে ত্রিবেণী/ যাত্রীদের কোলাহলে কিছুই না শুনি”। হালিশহর স্টেশন থেকে গঙ্গা প্রায় ৩ কিমি । স্টেশন দিয়েএলে দেখে নেবেন বিখ্যাত শীতল বাড়ি । আর সুন্দর কত সুন্দর সুন্দর জায়গার কথা বলা বাকি থেকে গেল। একদিনের ভ্রমণের জন্য আদর্শ জায়গা । রয়েছে সুন্দর সুন্দর পিকনিক স্পট ॥
হালিশহরের গঙ্গায় সূর্যাস্ত ॥ ছবি তাপস কুমার দত্তকোথায় কোলাহল? এখনোও সে কোলাহল নেই ।বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী পার্ককে বসে থাকলেই মন আনন্দে ভরে যায় । সিদ্ধেশ্বরী ঘাট সেখানে বসে থাকলে মনে হয় নিজেকে আরেক বার খুঁজে পাওয়া। গঙ্গার তীরে নিরিবিলি একটা মফস্বল সহর কলকাতা থেকে কতই বা দূরে মাত্র ৪০ কিমি ।
দারুণ দরকারী
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনখুব ভালো লাগলো। হালিশহর দেখা হয়ে গেল আপনার লেখার সাথে। সত্যিই কোন দিন দেখা হবে কিনা জানিনা। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনআমি এই হালিশহরের বাসিন্দা চল্লিশ বছরের বেশী।
উত্তরমুছুনআজও হালিশহর সবটা চেনা হয়ে ওঠেনি।
যেভাবে ওনার চোখ দিয়ে হালিশহরকে চেনালেন।সেটা এক কথায় অপূর্ব।
খুব ভালো লাগলো
মুছুনDarun
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনখুব ভালো লাগল বামাদা। চেনা হালিশহরের ছবিতে তোমার চিত্ররূপ দারুণ।
উত্তরমুছুনতোমরা লেখা পড়ছো ॥ । আমি খুব আনন্দ পাচ্ছি
মুছুনখব ভালো লাগলো বামাদা
উত্তরমুছুনধন্যবাদ তাপস
মুছুনখুব সুন্দর বর্ননা দিয়েছেন দাদা। এই হালিশহরের সাথে আমার জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। তাই হালিশহরের গল্প কাহিনী আমাকে ভীষণ ভাবে মোহিত করে। এর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। আপনি ভালো থাকবেন আর সকলকে খুব খুব সুন্দর নতুন নতুন গল্প পরিবেশন করবেন।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
মুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনNice
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর।
উত্তরমুছুনDarun lakha
উত্তরমুছুনআপনার হালিশহর সম্পর্কে বর্ণনা মন ছুঁয়ে গেল।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা
মুছুনApnar Halishahor ghure esecilm 2018 tey..Darun legecilo..
উত্তরমুছুনশুনে ভালো লাগল
মুছুনthanks
উত্তরমুছুনthanks
উত্তরমুছুনthanks
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনVery nice
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর লেখা। যদিও হালিশহরে কোনো দিন যাইনি, তবুও মনে হয় হালিশহর যেন আমার খুব পরিচিত জায়গা।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুনSundar information.
উত্তরমুছুনVery nice write up
উত্তরমুছুনপড়লাম। খুবই ভালো লাগলো। এত বছর পরে যেন আবার মনটা ঘুরে এলো আমার শৈশব-বাল্য-কৈশোরের সোনালী দিনগুলো কাটানো স্থানগুলোতে 😄😄
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন