বিদেশে পাসপোর্ট হারানোর গল্প


 পাসপোর্ট হারানোর কথা 

॥ বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় ॥ 

সকাল তখন ৭ টা  হবে । প্রাতরাস হলে প্রায় ১০০ জন মানুষ । এর মধ্যে  আমাদের টিমের এক বয়স্ক মানুষ এসে বল্লেন : আমার পাশপোর্ট মনে হয় হারিয়ে গেছে । সারা ঘরে খুঁজেও পেলাম না । হঠাৎ আমার মাথাটা অন্ধকার হয়ে গেলো । মনে হলো প্রাতরাস টেবিলের সমস্ত কাঁচের প্লেট  গুলো ভেঙে পড়লো এক সাথে । আমার মুখ দিয়ে শুধু একটা কথাই বের হলো ' মানে ' ? কোথায় গিয়েছিলেন কাল ? ভদ্রলোক বল্লেন:  কাল এলকাইজার শো তে নিচু হয়ে ঢুকতে গিয়ে মনে হয় পড়ে  গেছে । সাথে সাথে ওনার রুম মেটকে ডেকে পাঠালাম । তিনি এসে বল্লেন , সকাল থেকে সারা ঘর খুঁজেও আমি পাইনি ।কোরালদ্বীপে যেতে হবে  সকাল ৮ টার মধ্যে। বাসরেডি আমারা  এসেছি ৪৬ জন মানুষ । বাসে ওঠার আগেই সেই বার্তা রটে গেলে ক্রমে ।পাশপোর্ট হারিয়েছে কী হবে ? কী হবে দাদা ? বিদেশ বিভুঁইতে কত কিছু হারিয়ে যায় । এ কিনা  পাশপোর্ট ? আমিও মাথায় আনতে পারছি না কী করবো ? থাইল্যান্ডের ভাষা বলতে পারি না । ইংরেজি বল্লে কেউ বুঝতে চায় না । কার কাছে যাই । থানায় গিয়ে বল্লে ওরা কী ডাইরি নেবে ? পুলিশ যদি ওঁনাকে আটকে রাখে ? থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক । আমরা আছি পাটেয়াতে । বাসে উঠে বললাম কোন চিন্তা নেই আপনি আপনার মতো করে বেড়ান । আর কেউ যেন এ নিয়ে আলোচনা না করে । আমাদের গাইড নাথালিকে শুধু বিষয়টা বলে রাখলাম । 


                                 এই নিয়ে ৭ বার  থাইল্যান্ডে এসেছি । রাস্তা ঘাট সামান্য কিছু চেনা । কিন্তু এই চেনা দিয়ে আর যাই হোক  পাশপোর্ট খুঁজে বের করা যায় না । কী করবো নিজেই বুঝে উঠতে পারছি না । আমি যখন প্রথম থাইল্যান্ড ভ্রমণ করবো ঠিক করেছিলাম সেই সময়ও কিছুই জানতাম না । না জেনেই ৩৫ টা বিমানের টিকিট কেটে ফেলেছিলাম । তখনও একটা লোককেও বলিনি থাইল্যান্ড ভ্রমণ করবো । এতো টাকার টিকিট কী হবে । তিন রাত না ঘুমিয়ে কেটে গেছে । আস্তে আস্তে লোক জন কে বলতে শুরু করলাম । লোকজন ৩৫ থেকে ৪০ জন হয়ে গেলো। তখনও জানিনা থাইল্যান্ড গায়ে মাখে না মাথায় দেয় ? ভ্রমণের ১৫ দিন আগে চলে গিয়েছিলাম সে দেশ জানতে । সেদিন যেমন অচেনা লেগেছিল আজ মনে হচ্ছো সে রকমই অচেনা দেশটা । 

রাত বাড়ছে টেনশনও বাড়ছে । ওয়াকিং স্ট্রিট থেকে বিচের ধারে বসে বসে ভাবছি কি করবো । ওয়াকিং স্ট্রিটের আলোকিত রঙিন যেমন মাথা  ঘুলিয়ে দেয় তেমনি আমার মাথায় মেঘ ঢুকে সব বৃস্টি হচ্ছে । কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লাম । 

 থাইল্যান্ডের বিচে 

              পরের দিন সকালে উঠে দেখি মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে পাটেয়াতে । আমাদের যেতে হবে ব্যাংকক । ওখানেই ভারতীয় দূতাবাস । বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওনাকে নিয়ে চলমান ব্যাংকক । টিমের দায়িত্ব দিয়ে গেলাম  সুমনের ওপর । বাসস্ট্যান্ড গিয়ে শুনলাম ১০টার আগে বাস নেই । সেই বাস ছাড়ল ১০ ৩০মিনিটে । ব্যাংকক বাসস্ট্যান্ড থেকে ভারতীয় দূতাবাস যেতে হবে । অনেক খোঁজখুঁজির পর যখন পেলাম তখন ঘড়িতে ১২টা ৫। ভারতীয় দূতাবাস আবার খুলবে বিকেল তিনটে । আজ ২৪ তারিখ । ২৭ তারিখ বিকেলে ফেরার বিমান । হাতে আর দুদিন সময় । সকাল থেকে পেটে কোন ডানাপানি পরেনি । 7/11 দোকানে গিয়ে কফি খাবো ভাবছি । সেই সময় এক ভদ্রলোক ভারতীয় দূতাবাস থেকে বের হলেন । তাকে গিয়ে সব ব্যাপারটা বললাম । ইংরাজিতে কথাবার্তা চলছে । হঠাৎ ভদ্রলোক বাংলায় বলে উঠলেন বাঙালি হয়ে পুলিশকে বলতে পারবেন না হারানোর  একটা গল্প ? থানায় যান। হ্যাঁ , একটা কথা ডাইরিটা  ইংরাজিতে করিয়ে আনবেন । বাঙালি পেয়ে বুকে বল পেলাম । কোথায় থানা তাও জানিনা । ওখান থেকে ফিরে এলাম ব্যাংকক হোটেল । সেখানে আমার নামে একটা ঘর নিলাম । আর হোটেলে  বলে এলাম পুলিশ যদি ফোন করে , বলবেন দুদিন ধরে আমি এই হোটেলে  আছি । আমার টিম হোটেলে আসবে বিকেলে। কফি খাওয়া মাথায় থাক । অনেক কষ্টে থানায় পৌছলাম।

 মার্বেল বুদ্ধমন্দির 

 অফিসার বসতে বল্লেন । যা বলি কিছুই তিনি বুঝতে পারছেন না । ' ওনলি থাই'  । শেষমেষ একজন ইংরাজি জানা অফিসারকে তলব করা হলো । তিনি শুনে একটা ডাইরি করে নিলেন । কিন্তু থাই ভাষাতে তার কপি দিলেন । ইংরাজি লেখা না থাকলে ভারতীয় দূতাবাসে কিছুই জমা  নেবে না । মহা মুশকিল । আমার এক  গাড়োয়ালি বন্ধু ব্যাংককে থাকে । তার বাড়ি আলমোড়ায় । সে এখানে বেশ ভালো পজিশন করেনিয়েছে । তাকে ফোন করতে সে আমাদের কাছে পৌঁছে গেলো । সে আমাদের নিয়ে গেলো এক উকিলের কাছে তিনি থাই থেকে ইংরাজি করে তার প্যাডে স্ট্যাম্প দিয়ে সই করে দিলেন । নিলেন আটশ ভাট । ভারতীয় টাকায় প্রায় ১৬৫০ টাকা । আবার চারটের  সময় চলে গেলাম ভারতীয় দূতাবাসে ।তারা একটা ফর্ম দিলেন ৫ পাতার । সেটা ফিলাপ করে সমস্ত কাগজ পত্র দিয়ে কাল আসতে বললেন । আর যা যা ডকুমেন্ট দিয়ে পাসপোর্ট বানিয়ে ছিলেন সে গুলোর কপি  লাগবে । আর লাগবে হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্ট এর প্রথম পাতা শেষ পাতা জেরক্স কপিটা। আমার কাছে ওনার পাসপোর্ট এর কপি এবং প্যান কার্ডে কপি  ছিল মেলে । আর মণ্ডল বাবুর কাছে ছিলো ভোটার কার্ড । সমস্যা মিটলো । কাগজ পত্র তা হলে জমা করা যাবে । 

 ফি ফি আইল্যান্ড 

              হোটেলে ফিরে এসে দেখি আমার মোবাইলটা নেই । নেই তো নেই । তাকে আর পেলাম না । ফোন করলে ফোনটা বাজছে । বাড়িতে খবর দিলাম ফোনটা হারিয়ে গেছে । দেবশ্রী  খবরটা পাওয়ার পর ক্রমাগত ফোন শুরু করতে থাকলো ভারত থেকে । হটাৎ একজন ফোনটা ধরে । থাই ভাষায় যা বলেছিলো । সেটা শুনে থাই থেকে ইংরাজি করে আমাদের সে  জানালো । আমাদের গাইড সেই প্রাপকের সাথে কথা বলে তার ঠিকানা নিল । সে জানালো একজন থাই জানা লোক এসে ফোনটা নিয়ে যাক । আবার আমার বন্ধুর সহযোগিতা চাইলাম ।



 গোল্ডেন বুদ্ধমন্দিরের সামনে 

ভোর হতেই চলে গেলাম ভারতীয় দূতাবাসে । কাগজ পত্র জমা দিলাম । সকাল  ন'টায় । কাল আমাদের বিমান । জানি না কি হবে ? সকলের মুখে একই কথা কিছু হলো । পাসপোর্ট এর কিছু হলো ? পরের দিন সকালে আবার আমরা  ভারতীয় দূতাবাসে চলে এলাম । ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না । কেউ কোন কথা বলছেন না । একজন  হিন্দিতে  বল্লো বসুন । বসেই আছি প্রায় ২ঘন্টা । কোন কথা নেই । যিনি আমাদের বসতে বলেছিলেন তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছি না । টেনশন এতো বেড়ে গেছে  মণ্ডলবাবু  দুবার বাথরুমে চলে গেলেন ।  ঠিক  ১১ টার সময় একজন অফিসার আমাদের ডাকলেন । কাগজ পত্র সই করালেন ।  আমাদের হাতে তুলে দিলেন দু পাতার সাদা রঙের পাসপোর্ট । আমরা চললুম বিমান বন্দরে । খবর পেলাম আমার বন্ধু আমার মোবাইল হোটেল পৌছে দিয়ে গেছে আর সেটা ভারতে বসে  সবটাই দেবশ্রী করেছে ।  বিমান বন্দরে এসে বোর্ডিং পাস নিতে গিয়ে শুনি ওঁনাকে  বোর্ডিং পাস দিতে চাইছে না বিমান কর্তৃপক্ষ । কি সমস্যা ? mondal আর mandal সমস্যা । আবার  পাসপোর্ট ভুল ? কি হবে ? ওনার টিকিটে আছে Mondal আর পাসপোর্ট আছে Mandal । কিছুতেই বোর্ডিং পাস ইস্যু হবে না। কী করি অনেক কাকুতি মিনতিতে ফল হলো না । কোন রকমে  তো পাসপোর্ট  পেলাম  এবার কী হবে । ভদ্রলোকের  প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখ। তাহলে কি তীরে এসে তরী ডুবে গেল? হ্যাঁ গেলোই ! ভাবছি নতুন করে একটা টিকিট কাটতে হবে। সবাই চলে গেছে তখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে। যে কোম্পানির বিমানে আসছিলেন তাদের কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম যদি বলে কয়ে কিছু হয় । হটাৎ দেখি  যে কম্পানির বিমানে আসছিলাম , তার ইঞ্জিনিয়ার কাম অফিসার  কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছেন । তিনি হালিশহরের লোক আমার চেনা মানুষ । তিনিই মুশকিল আসান করে আমাদের  বিমানে তুলে দিলেন ।

 হোটেলের সামনে আমরা

বিদেশে পাসপোর্ট হারালে করণীয়

অনেকে বিদেশে ঘুরতে গিয়ে পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন। কেউ যদি বিদেশে গিয়ে পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলেন তাহলে সর্বপ্রথম তাকে সে দেশের  দূতাবাসে চলে যেতে হবে। (১১ টা থেকে  ৩ টের মধ্যে) তারপর সরাসরি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হোন এবং পাসপোর্ট হারানোর কথা বলুন। এক্ষেত্রে বিদেশের যে এলাকায় বা থানায় পাসপোর্ট হারিয়েছে সেখানকার থানায় একটি জিডি করতে হবে। জিডি করার পর সে জিডি কপি সহ আপনি বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে অন্যান্য কাজগুলো জমা দেবেন। সমস্ত কাগজ জমা দেওয়ার পর তারা মূলত আপনাকে ট্রাভেল পারমিট দেবেন। ট্রাভেল পারমিট মূলত পাসপোর্টের বিকল্প পরিচয়পত্র, যেটি বহন করে আপনি নির্দিষ্ট সময় ভ্রমণ করতে পারবেন।

ট্রাভেল পারমিটের জন্য যেসব কাগজপত্র দূতাবাসে জমা দিতে হবে, যেমন-

১. হারানো পাসপোর্টের ফটোকপি

২. হারানো পাসপোর্টের ভিসা এরাইভাল হওয়ার কপি

৩. কয়েক কপি ছবি

৪. থানার জিডি কপি

৫. C Form/সি ফর্ম তথা যে দেশে থাকছেন সেখানকার ঠিকানা ও তার প্রমাণপত্র।

৬. সব কাগজের সঙ্গে পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে জানিয়ে একটি ট্রাভেল পারমিট ইস্যু করার জন্য আবেদন করতে হবে।

সাধারণত সমস্ত আবেদন সম্পন্ন করার কোনো সমস্যা না থাকলে সেদিনই ট্রাভেল পারমিট প্রদান করবে।

কাজেই পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলাটা, বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে পাসপোর্ট হারানো অত্যন্ত ঝামেলাপূর্ণ একটি কাজ। যে ধকল পোহাতে হয় তার রেষ থেকে যায়। পরবর্তীতে দেশে এসে নতুন করে পাসপোর্ট করার সময়ও দেশের কোনো থানায় পুনরায় জিডি করতে হয়। তারপর সে জিডি সহ সে দেশের করা জিডি, ট্রাভের পারমিট, এক্সিট পারমিট সহ বাকি যাবতীয় কাজ জমা দিয়ে নতুন করে পাসপোর্ট এর আবেদন করতে হয়। প্রকৃতপক্ষে পাসপোর্ট হারিয়ে গেলে আরেকটা যে কষ্টের কাজ হয় সেটি হলো, পাসপোর্টে থাকা কোনো ভিসা-সিল আর ফিরে পাওয়া যায় না নতুন পাসপার্টে। তবে পুরনো পাসপোর্টের নাম্বারটি তারা নতুন পাসপোর্টে উল্লেখ করে দেবে। তারপর ফেরার দেশে ফেরার জন্য দূতাবাস থেকে ওয়াইট পাসপোর্ট আপনার হাতে তুলে দেবে।

মন্তব্যসমূহ

  1. Eta apner mookh theke age sunechilam.Apner lekha poreo khoob valo laglo.Valo thakben, sustho thakben.

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম