সাঁচিতে কি দেখবেন

 সাঁচি

বামাপদ  গঙ্গোপাধ্যায় । 

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা। জীবনানন্দ দাশ কি কখনো বিদিশায়  গিয়েছিলেন? তাহলে কোথা থেকে পেয়েছিলেন সেই অন্ধকারকে? পেয়ে ছিলেন মনে হয় এক বাঙালির  কাছ থেকে । তিনি বিপিনবিহারী ঘোষাল । জন মার্শাল ও বিপিনবিহারী ঘোষাল মিলেই  সাঁচি স্তুপ খননের কাজে নেমে  ছিলেন । কবি ও লেখক দের সাথে বিপিনবিহারী ঘোষালের   দারুণ সখ্যতা ছিলো। ৫ মে ১৯২২, শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে ইংরেজিতে একটি চিঠি লেখেন বিপিনবিহারীকে। তার কিছু দিন আগেই রবীন্দ্রনাথের সাঁচি যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল । বিপিনবিহারী সব ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। হঠাৎ কোন কারণে  যাত্রা স্থগিত করতে হয় । না  যেতে পেরে দুঃখ প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ । সাঁচি আর যাওয়া হয়নি রবীন্দ্রনাথের।  একটি নক্ষত্রের রাতে আমিও খুঁজতে গিয়েছিলাম বিদিশার অন্ধকারকে। বিদিশার ধানক্ষেতে একটা বিরাট লৌহস্তম্ভ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনি। অথচ এখানেই ছিল রাজা অশোকের শ্বশুরবাড়ি। আমরা বিদিশায় আর যাবো না । যাবো সাঁচী। 

' সাঁচীর স্তূপ মৌর্য্য সম্রাট অশোক দ্বারা খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় অব্দে নির্মিত হওয়ায় এটি ভারতের পাথর নির্মিত প্রাচীনতম স্থাপত্য হিসেবে গণ্য হয়। অশোকের স্ত্রী দেবী এই স্তূপ নির্মাণের দেখাশোনা করেন।' এখান থেকে বোঝা যায়  না গৌতম বুদ্ধ না সম্রাট অশোক, না রবীন্দ্রনাথ , না জীবনানন্দ , কেউ যাননি এই সাঁচীতে। তবে শোনা যায় কি দেখব এই সাঁচীতে এসে? কেন সাঁচী হলো । 
সাঁচির গেট সহ স্তূপ

সিংহলী বৌদ্ধ গ্রন্থ মহাবংশ অনুসারে, দেবী বিদিশার একজন ব্যবসায়ীর কন্যা ছিলেন এবং উজ্জয়িনী নগরীতে শাসক থাকার সময় মৌর্য্য রাজকুমার অশোকের সঙ্গে তার বিবাহ  হয়। ২৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাদের এক পুত্র মহেন্দ্র   ও ২৮২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সংঘমিত্রা নামে  এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। দেবী অশোককে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে তার দুই সন্তানকে নিয়ে পাটলিপুত্র থেকে বিদিশা চলে যান। মহাবংশ গ্রন্থানুসারে, দেবী শাক্য গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তার পরিবার বিদিশায় চলে আসেন, কিন্তু এই ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে ঐতিহাসিকেরা সন্দিহান। শাক্য সম্প্রদায়ভুক্ত গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে সিংহলে প্রথম বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক হিসেবে পরিচিত মহেন্দ্র  ও সংঘমিত্রার যোগসূত্র দেখানোর জন্যই নাকি সিংহলী বৌদ্ধরা এই কাহিণীর জন্ম দিয়েছেন বলে ঐতিহাসিকদের মত। 

শাক্য নিয়ে আমার চিন্তা নেই । হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায় নিয়েও আমি লিখবো না । এসব লিখবেন ইতি হাসবিদরা । আমার ভাবনা কে করেছিলেন এই সাঁচি ?   এটা পরিষ্কার যে  ভোপাল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে যে সাঁচি স্তুপ পাওয়া গিয়েছিলো তা নির্মাণ করেছিলেন অশোকের স্ত্রী দেবী। 

১৯১৩ সালে জন হুবার্ট মার্শাল ছিলেন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল । সাঁচির প্রত্নক্ষেত্রর পিছনে মার্শালের ভূমিকাই সব থেকে বেশি। নিঃসন্দেহে মার্শালই সাঁচির গৌরব পুনরুদ্ধার করেন। মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা স্তূপ মন্দির ছাড়াও আশপাশের এলাকায় উৎখনন চালিয়ে খুঁজে বার করা যাবতীয় স্থাপত্যের সংস্কার, এবং ভাস্কর্যগুলি সংরক্ষণের জন্য আলাদা সংগ্রহশালা গড়ে তোলা, সবই সম্পন্ন হয় তার সময়।

ভূপাল থেকে সকালবেলা বের হয়েছি। অনেকটা যাবার পর ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন,  এটা একটু দেখে নিন। কি দেখবো ? কাল রাস্তার ওপর সাদা একটা বর্ডার তার ওপরে লেখা কর্কটক্রান্তি রেখা। মাথার উপরে এই লাইন দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। একটা ফলকে সে কথা লেখা আছে । আমার মাথায় ঘুরছে অন্য রেখা । পাটালিপুত্র থেকে তার স্ত্রী চলে আসার পরে কি তার অনুশোচনা শুরু হয়েছিল? নাকি কলিঙ্গ যুদ্ধের পরিতারে অনুশোচনা ? চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক তাঁকে কে করলো ? তবে শোনা যায় সম্রাট অশোক উপগুপ্তর কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়ে এখান থেকেই নাকি তার বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার কর্ম শুরু হয়। 

স্তূপ

        সেই সময় কোন টিকিট লাগতো না সাঁচি দেখতে। এখন মিউজিয়ামের সামনের কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে তারপরে সাঁচিতে যেতে হয়। ভুল করে টিকিট না কেটে একদম সাঁচির সামনে চলে গেলে আবার দু কি.মি হেঁটে আসতে হবে টিকিট নিতে । গেট থেকে একটু এগোলেই দেখা যায় শ্রীলংকার বিরাট পতাকা উড়ছে। ১৯৫২ সালে সিংহলিরা তৈরি করেছিলেন নতুন বৌদ্ধ বিহার।  চারিদিকে রুক্ষ পাথর, টিলার উপরে দাঁড়িয়ে আছে সাঁচি স্তুপ। এখানে গাইড চাই । তা না হলে কোন কিছুই বোঝা সম্ভব নয় । বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার এর জন্য সারা ভারতে অশোক প্রায় ৮৪০০ টি স্তুপ তৈরি করেছিলেন তার মধ্যে আটটি স্তুপ ছিল সাঁচিতে। এই আটটি মধ্যে তিনটি এখনো তার সাক্ষী বহন করে চলেছে কালের নিয়মে বহু সময় ধরে স্তুপ গুলো ছিল মাটির তলায়। বড় গেট পেরিয়ে সবুজ ঘাসের লন চারিদিকে গাছের শোভা। গেট পেরিয়ে  ফাক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সাঁচি স্তুপকে। অশোক স্তুপটি  বানিয়েছিলেন তার ব্যস  ছিল ১৪.৬ মিটার ।প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় জানা যায় বর্তমান ব্যসের অর্ধেক মূল স্তুপ। 

মূল স্তুপের কিছু অংশ ভেঙে গেলে পরবর্তীকালে তা পাথর ফলক দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। বর্তমানে বৃহৎ যে স্তুপটি দেখা যায় তার ব্যাস প্রায় ৩৬.৬ মিটার এবং উচ্চতা ১৬.৫ মিটার

সাঁচির ১ নম্বর এবং ৩ নম্বর স্তূপের চারদিকে রয়েছে ৪টি তোরণ। তোরণের কারুকাজগুলো খুবই সূক্ষ্ম। এর রহস্য উদ্ধারের জন্য যেতে হবে হাতির দাঁতের শিল্পী, স্বর্ণকার এবং কাঠের সেসব সূক্ষ্ম শিল্পীদের কাছে যারা এ তোরণ নির্মাণ করেছেন। আর স্তূপের ব্যাখ্যা হলো ১ নম্বর স্তূপের মধ্যেই গৌতম বুদ্ধের দেহভস্ম রাখা আছে। ৩ নম্বর স্তূপে আছে বুদ্ধের শিষ্য সারীপুত্র এবং মহামোগ্গলানার ভস্ম। মজার ব্যাপার হলো, সাঁচি বৌদ্ধধর্মের পবিত্র জায়গা হলেও এখানে কোন বৌদ্ধ মূর্তি নেই। এর কারণ হলো, তখন পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মে মূর্তিপূজা অনুমোদন পায়নি। আরেকটি কারণ হতে পারে বিদিশা অঞ্চলে কারুশিল্পী থাকলেও তেমন ভালো মূর্তি শিল্পী ছিল না। তাই পুরো সাঁচিতে স্তূপগুলোতে কখনও ধর্মচক্র, কখনও পদচিহ্ন আবার কখনও অশ্বত্থ বৃক্ষ এঁকে বুদ্ধির উপস্থিতি বোঝানো হয়েছে। 

মূল গেট

সে যাই হোক ১ নম্বর স্তূপের উত্তরমুখী তোরণ থেকে দক্ষিণ দিকে গেলে চোখে পরবে খুবই পুরনো দুটি মন্দির। দেখতে অনেকটা প্রাচীন গ্রিক কিংবা রোমান মন্দিরের মতো।

মূল স্তুপের দক্ষিণ দিকে রয়েছে অশোক স্তম্ভ।  অশোক  ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যেরকম স্তম্ভ বানিয়েছিলেন সেরকমই। একটি বেলেপাথরের স্তম্ভের উপর চারটি সিংহের মূর্তি। স্তম্ভ বা পিলার টির উচ্চতা ১২.৮ মিটার। এখানে  রয়েছে ১৮ মন্দির এবং বেশ কিছু স্তূপ । সাঁচি স্তুপ দেখা হয়ে গেলে নিচে নেমে মিউজিয়ামটি দিকে নিয়ে যায়। মিউজিয়ামটা বেশ ভালই ।  প্রতিদিন সকাল ৭টায় খুলে আর বিকেল ৬ টায় বন্ধ হয়ে যায় ।

মন্তব্যসমূহ

  1. বাঃ, খুব তথ্যবহুল, পড়ে ভাল লাগলো

    উত্তরমুছুন
  2. অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশনা।সমৃদ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন
  3. বাঃ বেশ ভালো লাগলো আপনার বর্ণনা পড়ে। আপনি বরাবরই ভালো লেখেন, বেশ আনন্দ পাই আপনার লেখায়।

    উত্তরমুছুন
  4. ভালো লিখেছেন। ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  5. তথ্য বহুল লেখা,পড়তে যেমন ভালো লাগে তেমনি অনেক কিছু জানা যায়।

    উত্তরমুছুন
  6. Khb vlo laglo.... Onk kotha janlam ja itihaas boiye pawa jayna....

    উত্তরমুছুন
  7. বরাবরের মতই অসাধারণ। যেন সুন্দর একটা চলমান সিঁড়ি। লক্ষ্যে পৌঁছাতে পাড়ি দিই তরতর করে।

    উত্তরমুছুন
  8. ইতিহাস, কল্পকথা,প্রত্মতাত্তিক ব্যাখ্যা ও বর্ত্তমান বাস্তব মিলেমিশে এক অদ্ভুত নান্দনিকতায় ভরা আপনার লেখা। অনেক দাম আপনার এই পরিশ্রমের।
    লিখতে থাকুন,আর আমরা পাঠ করে ঋদ্ধ হ‌ই।কলম যেন না থামে।
    ডাঃঅচিন্ত্য কুমার পোদ্দার।ভিলাই।

    উত্তরমুছুন
  9. আপনার যেকোনো লেখাই অসাধারণ ।

    উত্তরমুছুন
  10. তথ্যবহুল পরিবেশনা ।পড়ে খুব ভালো লাগলো ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম