ভীমভেটকার গুহা চিত্র।

 ভীমভেটকা

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় ।

জিভ-কাটা লোকটা এখনও লুকিয়ে আছে এই পাহাড়ের মধ্যে? আর সেই লোকটা গুহামানব সেজে তাদের ভয় দেখিয়েছিল? গুহাগুলো সবই পাহাড়ের একদিকে। সেখানে যে গুহার মধ্যে এত ছবি আছে, তার সব ছবি স্রেফ ছবি নয়। সেগুলো ভাষা। তার মানে চিত্রভাষা। মিসরে পিরামিডের মধ্যে যেমন হিয়েরোগ্নিফিকস, অর্থাৎ ছবির মধ্যে ভাষা আছে, সেই রকম! ভূপালে রাত্তিরবেলা অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় পাহাড়টাকে কী রকম ভয়ের জায়গা বলে মনে হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূপাল রহস্য’কিশোর উপন্যাসে এই ভাবেই দেখা হয়েছিল 

যুদ্ধের ছবি 

ভীমভেটকাকে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাটি পড়ার আগেই একবার গিয়ে ছিলাম ভীমভেটকা । ঘন জঙ্গল , পাথরের রুক্ষ ভূমি , মানুষজন নেই , রহস্য-রোমাঞ্চ এর মত লুকিয়ে থাকে একটা স্তব্দতা। ভূপালের আব্দুল্লাহ গঞ্জ । রেল লাইন পার করলেই বিন্ধ্য পর্বতের উঁচু নিচু ঢেউ। আর এখানে লুকিয়ে আছে মানব সভ্যতার এক প্রাচীন নিদর্শন। গুহাচিত্র । গুহাচিত্র বললেই আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে অজন্তার ছবি। বুদ্ধদেবের সমসাময়িক বুদ্ধদেবের পরে আমরা অজন্তার গুহাচিত্র কে পেয়েছি। আর ভীমভেটকার গুহাচিত্র অনেক অনেক বছর আগে । প্রথম গুহাচিত্র, যেখানে জীবজন্তুর দেখা পাওয়া যায় সে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার বছর আগেকার। পাওয়া গেছে ইন্দোনেশিয়ায়। আর প্রাচীন যে অবয়বচিত্র পাওয়া যায় সেটাও প্রায় ত্রিশ থেকে বত্রিশ হাজার বছরের পুরোনো যেটা ফ্রান্সে পাওয়া গেছে। কিন্তু এর চেয়েও প্রাচীন চিত্র পাওয়া গেছে স্পেনের ক্যান্টাব্রিয়ার এল-ক্যাস্টিলো গুহায় প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগের। আমাদের দেশেও আছে এমন প্রাচীন গুহাচিত্র। যেটা মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপালের থেকে ৫০ কিলো মিটারের মধ্যেই ভীমবেটকায় । সেখান কার গুহায় আঁকাগুলি ছবি গুলো আজ থেকে প্রায় ত্রিশ হাজার বছরের পুরোনো।

হরিণ 

  স্পেনের আলতামিরা গুহাচিত্রের সঙ্গে তুলনীয় ভীমবেটকার গুহাচিত্র। প্রায় ৩০০০০ বছর আগের থেকে এখানে গুহাচিত্র এঁকেছেন আমাদের পূর্বসূরীরা। সভ্যতা সংস্কৃতির ধারনাই যখন তৈরী হয়নি, তখন কিভাবে এত নিখুঁত ছবি আঁকা হতো, সেটাই আজকের সভ্যতার কাছে একটা বিস্ময়! প্রথম যুগের শিকারজীবী মানুষের ছবি যেমন আছে, তেমনি আছে পরবর্তীকালের যুদ্ধরত মানুষের চিত্র। চিত্রের বিষয় বৈচিত্র এবং আঁকার মাধ্যমের পরিবর্তন থেকে বিশেষজ্ঞরা ভীমবেটকায় মানবসভ্যতার বিবর্তনের ধারাটি খুঁজে পেয়েছেন। যুগ থেকে যুগান্তরে ভারতীয় উপমহাদেশে মানবসভ্যতার প্রথম আলো হিসাবে ভীমবেটকা ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পেয়েছে ২০০৩ সালে। ভীমবেটকা শব্দটি এসেছে হিন্দি শব্দ ভিমবইঠকা থেকে, যার অর্থ ভীমের (মহাভারত কাব্যের পঞ্চ পাণ্ডবদের এক ভাই) বসার স্থান। মধ্য প্রদেশে রাইসেন জেলায় অবস্থিত আর  ভোপাল শহরের ৪৫ কিলোমিটার দূরে । ভীম যেখানে বসতেন সে সব পাথর তো বড় বড় হবেই ! ভীম তো শিল্প রসিকও ছিলেন না ! মজার কথা  রামায়ণ বা মহাভারত ঘোড়ার পিঠে চেপে যুদ্ধ করার ছবি আমি  কিন্তু দেখিনি। ঘোড়ায় টানা রথ ছিল কিন্তু ঘোড়ার পিঠে চেপে যুদ্ধ করার ছবি কিন্তু কোথাও মেলেনি। আছে কী না আমার জানা নেই  অশ্বারোহী বাহিনী ছিল । অশ্বমেধ ছিল।  হাতির পিঠে চেপে যুদ্ধ করার ছবি আমরা মহাভারতে পেয়েছি। শল্য এসেছিলেন হাতির পিঠে  চেপে । ১৮ নম্বর গুহাতে  হাতি, ঘোড়ার পিঠে  যুদ্ধের ছবি দেখছি । 

পশুপালন 

 অনেক বার এসে এসে মুখস্ত করে ফেলেছি কোন গুহায় কী আছে । ২০ টা গুহা দেখা যায় আর গুলো আমি দেখিনি । এই কুড়িটা গুহা নিয়েই আমি কথা বলবো । 

        ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ভি. এস. বাকঙ্কর (১৯১৯-৮৮) ট্রেনে করে ভোপালে যাওয়ার পথে জানালা দিয়ে পাহাড় সম্বলিত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছিলেন। হঠাৎ করে কিছু প্রস্তরক্ষেত্র বিশেষভাবে তার নজর কাড়ে। তিনি ফ্রান্স ও স্পেনে দেখা প্রাচীন গুহা ও প্রস্তরক্ষেত্রের সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পান। পরবর্তীতে ১৯৫৭ সালে তিনি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক দল নিয়ে সেখানে আবার আসেন। কিন্তু এবার এসেছিলেন আবিষ্কারের নেশায়। আর আবিষ্কার করেন আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন গুহাচিত্র, যেখানে প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বসবাস করেছে।  

আমিও সেই জাতিগোষ্ঠীর একজন ভেবে একটা লাঠি কাগজ পেন পিঠে একটা ব্যাগ নিয়ে ডুকে পড়ি জঙ্গলে। শাল সেগুনের জঙ্গলে একটা সুন্দর গন্ধ আছে , আর এই গন্ধর ভেতরে লুকিয়ে থাকে ভয় । আসলে আমার এটাকে রক সেলটার  মনে হয়েছে । সেই জন্য ভয় নেই । দুটো বিশাল  পাথরের ভেতর দিয়ে আমি প্রথমে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলাম। একটা কথা বলে রাখি তখন কোন এন্ট্রি ফিস ছিলনা আর প্রত্যেকটি ছবি আমি  হাত দিয়ে ছুঁতে  পেয়েছি। প্রথম গুহাটা দেখে আমার মনে হয়েছিল গেরুয়া রং এর কোন পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটা। আস্তে আস্তে চোখের সামনে ভেসে উঠলো অসাধারণ সমস্ত ছবিগুলি। লাল রঙ, বাদামী, গাঢ় বাদামী রঙ দিয়ে ছবি আকতে দেখা যায়, কোনোরকম বহিঃরেখা ছাড়া, বড় করে সবকিছুকে তুলে ধরা হয়েছে (২-৮ ফুট লম্বা)। যেমন: হাতি, বাইসন ইত্যাদি। মানুষকে অনেক ক্ষুদ্র করে প্রতীকীরুপে আঁকা রয়েছে । ভীমবেটকা গুহাতে আঁকা চিত্রের বিষয়গুলো প্রাচীনকালে অংকিত অন্য যেকোনো গুহাচিত্রের চেয়ে বেশ সমৃদ্ধ। এই গুহার প্রাচীরগুলোতে শুধু একটি বিষয়েই নয়, বরং বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আঁকা হয়েছে। এখানে মানুষের প্রতীকী অবয়ব থেকে শুরু করে শিকারের দৃশ্য, ধর্মীয় চিহ্নসহ অনেক বিষয়ই স্থান পেয়েছে। বস্তার জেলা বা ছত্রিশগড়ের জনজাতি দের মধ্যে আকা যে সমস্ত শিল্পকর্ম আমরা দেখি  মনে হয় যেন এখান থেকেই নেয়া হয়েছে। শিল্প হচ্ছে একজন শিল্পীর মাথায় কল্পিত ধ্যানধারণার বাস্তবরূপ। আর শৈলী (Style)-কে বলা যেতে পারে শিল্পীর শিল্প রচনার নিজস্ব বুদ্ধিভিত্তিক কৌশল। এককথায়, তিনি কীভাবে তার চিন্তাভাবনাকে বাস্তবে রূপ দান করবেন। এতে করে একজন শিল্পীর নিজস্ব শৈলী ও কৌশল প্রকাশ পায়।

শিকার উৎসব 

কুড়িটি গুহার ছবির মধ্যে কোন ছবির সাথে কারোর মিল নেই আবার মিল আছেও  ও বলা যেতে পারে। প্রথম দিকের গুহাগুলোর মধ্যে  মানুষের ছবি ছিল  ছোট ছোট  জীবজন্তুর ছবি ছিল বড় বড় । কিন্তু ফিগার গুলো একই রকম । এখানে ছবি গুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায় ন্যাচারিলিস্টিক ,বিমূর্ত( অ্যাবস্ট্রাক্ট) জিওমেট্রিক কৌশল।

 ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে , এখানে প্রাপ্ত মানুষের অবয়বের এর সংখ্যা ২,৩৩০। পুরুষের সংখ্যা ২০৭৬, নারী ৭১, ছেলে ২৪, মেয়ে ২, শিশু ৬ এবং ১৫১টি খন্ডিত অবয়ব। এখানে মানুষের ছবির চেয়ে বিভিন্ন পশুপাখির ছবি কম, ১৩৭৭টি। চিত্রিত পশুপাখির মধ্যে আছে সিংহ, বাঘ, চিতা, গন্ডার, বন্যমহিষ, ষাড়, গরু, বাইসন, নেকড়ে, ছাগল, পেচা, বন্য শূকর ইত্যাদি। ভাবা যায় আজ থেকে ৩০ হাজার বছর আগের মানুষ এই ছবি এঁকে গেছেন ?যে ছবির কখনো রং উঠবে না , যে ছবিতে হাত দিলেও মুছে যাবেনা , যে ছবিতে কখনো বিদ্যুতের আঘাতে ও নষ্ট হবে না। কোথায় পেয়েছিলেন সেই রঙ , কোথায় পেয়েছিলেন সেই তুলি?  যা দিয়ে  আঁকা হয়েছিল সেই সমস্ত ছবি গুলো কে? তিন নম্বর গুহাতে প্রাণীগুলোকে মোটা এবং পুরু রেখায় আঁকা হয়েছে। আংশিক রঙ দিয়ে পূর্ণ ও শরীরে বিভিন্ন অলংকারিক  দিয়ে সজ্জিত। শিকারীদের দেখা যায় তারা বাইসন, হাতি, এন্টিলপকে ধাওয়া করছে।তিরিশ হাজার বছর আগেও মানুষ যুদ্ধ করেছে, শিকারের জন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়েছে। মানুষ যা দেখি সেটাই তার কল্পনায় ভেসে ওঠে সেটাই তার শিল্পকর্মে ভেসে ওঠে।মানুষ শুধু যুদ্ধ করেছে আর শিকার করেছে ভাবলে চলবে না সামাজিক ভাবে আনন্দে থাকারও চেষ্টা করেছে  । 

 পাথরের কচ্ছপ 

নাচ  এবং সংগীতের দৃশ্যগুলো সেই সময়ের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দৃশ্যগুলোকে তুলে ধরে। এখানে দেখা যায়, পুরুষ এবং মহিলা একত্রে নৃত্য করছে বাহুতে বাহু রেখে। এবং বাদ্যযন্ত্র বাদকরা তাদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সঙ্গ দিচ্ছে। এছাড়াও দেখা যায়, বাদকেরা অগ্রগামী সৈন্যদের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। পারিবারিক দৃশ্যগুলোতে দেখা যায় গর্ভবতী মহিলা, শিশু, বালক ও মুখোশ পরা পুরুষকে। পৌরাণিক দৃশ্যগুলোতে দেখা যায় কয়েকজন হিন্দু পৌরাণিক দেবতাকে, যেমন- গণেশ ও শিব। পাশাপাশি  বিভিন্ন প্রতীকী চিহ্নও পাওয়া যায়, যেমন- স্বস্তিকা, নন্দী (শিবের বাহন), ত্রিশূল প্রভৃতি। আমার মনে হয়েছে সব ছবি এক সময়ের নয় । বিভিন্ন সময়ে এই ছবি গুলো আঁকা । আমি চিত্রকর নই । এক দম  সাধারণ মানুষ হিসাবে বলছি । ভ্রমণ মানে তো শুধু পাহাড় পর্বত জঙ্গল মরুভূমি সমুদ্র নয়। ভ্রমণ মানে আরো আরো অনেক কিছু । ভারতে থেকে ভীমভেটকা না দেখাটা আমার কাছে মনে হয় বড় একটা না দেখা জিনিষ থেকে গেলো ।

কী ভাবে যাবেন   : সারা দেশের সাথে ভূপালের সাথে ট্রেন যোগাযোগ আছে । ট্রেনে করে এসে ভূপালে নামুন। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে । যদি অল্প খরচে যেতে চান তারা ভোপাল থেকে ট্রেন ধরুন আব্দুলগঞ্জের । আব্দুলগঞ্জ স্টেশন থেকে নেমে মাত্র 9 কিলোমিটার । 

কোথায় থাকবেন : ভীমবেটকা জঙ্গলের ভেতর থাকার কোন জায়গা নেই । সবচেয়ে ভালো ভূপালে ফিরে আসা । ভূপালে অসংখ্য হোটেল থাকার কোনো সমস্যা হবে না । 

মন্তব্যসমূহ

  1. 2010 সালে ভীমবেটকায় যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, তবে আপনার মত পুঙখানুপুঙখ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দিয়ে দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। স্মৃতিচারণের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার লেখা পড়ে জায়গা গুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে

    উত্তরমুছুন
  3. এ গুহা আমি বছর দুই আগে দেখে এসেছি। আপনার পাশে পাশে আবার ঘুরে এলাম।

    উত্তরমুছুন
  4. Darun, apnar songe manos bhramon korlam vimvetka. Okhane jabar ichha thaklo.

    উত্তরমুছুন
  5. প্রকৃত ভ্রমণ পিপাসি আপনি।আপনার থেকে আমাদের ও তেষ্টা মেটে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম