ক্ষুদ্রতম একটি দেশ , লিচটেনস্টাইন ॥

 ক্ষুদ্রতম একটি দেশ 

লিচটেনস্টাইন ভ্রমণ॥

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় । 

সুইজারল্যান্ড থেকে গাড়ি ছাড়ার পর , আমাদের গাইড বললেন : আপনাদের এমন একটা দেশে নিয়ে যাব সেই দেশটার নাম আপনারা কেউ শুনেনি । সেটা পৃথিবীর  ক্ষুদ্রতম ১০টি দেশের মধ্যে একটি । আর ইউরোপের মধ্যে চতুর্থতম কনিষ্ঠদেশ। আমাদের ট্যুর প্রোগ্রাম এর লেখা ছিল : সুইজারল্যান্ড থেকে অস্ট্রিয়া যাওয়া হবে ভায়া ভাদুজ । 

ভাদুজ শহর 

তখন কি আর জানতাম লিচটেনস্টাইনের রাজধানীর ভাদুজ ! ভাদুজ হ'ল লিচটেনস্টাইনের প্রিন্সিপ্যালিটির রাজধানী । শহরের মধ্যে যখন প্রবেশ করলাম । দেখি হলুদ রঙের একটা ট্রাম গাড়ি যাত্রী বোঝাই করে স্কোয়ারে এসে থামল ।গাইডকে বললাম  আমরাও এই ট্রামে চেপে ভ্রমণ করব । মাত্র সাত ইউরো দিয়ে বুকিং করতে হবে । আমাদের ভাগ্য খারাপ দুটো ট্রাম আগে থেকে বুক করা আছে ,এযাত্রায় আমাদের ট্রামে চেপে ভ্রমণ হবে না । আমি নিজে কাউন্টারে গেলাম । তিনি বললেন না কোন সিট নেই । আমার কাছ থেকে পাসপোর্ট টা চেয়ে নিয়ে বললেন আমাদের দেশে আসার জন্য ধন্যবাদ । আমার পাসপোর্টে ভিসার স্ট্যাম্প লাগিয়ে এক ইউরো চেয়ে নিলেন । 

এই করে শহর ভ্রমণ 

       ভাদুজের স্কোয়ার থেকে একটু অপরদিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাই ।  দেশটার যেদিকে তাকাই , আকাশের সাথে শুয়ে আছে আল্পস পর্বতমালা । মাথার উপরে বরফ , কোথাও কোথাও বরফের সরু রেখা নেমে এসেছে পাদদেশে । রাস্তার দু'পাশে ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি । এ যেন বর্ণময় শিল্পের এক দেশ । সংসদ ভবনের দিকে তাকালে মনে হয় এটাও কোন বড় শিল্পীর ভাস্কর্য । আমাদের দেশে সুনীল দাস আঁকা ঘোড়াগুলো মনে হয় সেদেশে ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আমাদের দেশের সাথে লিচটেনস্টাইনের একটা মিল । ১৫ আগস্ট  দুই দেশেরই স্বাধীনতা দিবস ।

টুরিস্ট সেন্টার 


দেশ না বলে একে একটা মফস্বল শহর  বল্লেও  বেশি বলা হয় । দেশটা সব মিলিয়ে ১৬০ স্কোয়ার কিলোমিটার ।লোক সংখ্যা প্রায় ৩৮০০০ হাজার । বড়  মহল্লা বলাটাই মনে হয়  ঠিক হবে । একপাশে সুইজারল্যান্ড অন্যপাশে অস্টিয়া।সুইজারল্যান্ডের সাথে লিশটেনস্টাইনের পশ্চিম সীমান্তের পুরোটাই রাইন নদী দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। দু পাশেই আল্পসের হাতছানি । কিছু দেশের সাথে কিছু দেশের মিল থাকে।  এই দেশটার সাথে কারুর মিল নেই,  একদম স্বতন্ত্র একটি দেশ। পৃথিবীর অন্যতম ছোট দেশে এসে শুধু বসে থাকা আর চেয়ে থাকা । নিঃসঙ্গ তম দেশ।  রাইন নদী একা বয়ে চলেছে শহরের বুক চিরে। আত্মমগ্নতা আর নিঃসঙ্গতার মিলন হলে যে উত্তাপ তৈরি হয় তার শীতলতম এক দীর্ঘশ্বাস এখানকার বাতাসে । 

যুদ্ধের সাথে কোন সম্পর্ক নেই এই দেশটির । সুইজারল্যান্ড এর মতই নিরপেক্ষ দেশ । নিজেদের কোন সেনাবাহিনী ও নেই । সীমান্ত পাহারা দেয় ,সুইজারল্যান্ডের পাহারাদাররা । দেশের রাষ্ট্রভাষা জার্মানি । কিন্তু মুদ্রা  সুইজারল্যান্ডে ।দেশে রাজা আছেন আবার পার্লামেন্টও আছে । পাঁচজন পার্লামেন্ট সদস্য নিয়ে দেশ চালানো হয় । 

অনবদ্য ঘোড়ার ভাস্কর্য 

আল্পস পর্বত বুক চিরে নেবে আসছে রাইন নদী । দু পাশে সবুজের হাতছানি । চারিপাশে আঙ্গুরের বাগান ।দূরে দেখি সেই বরফের আলপনায়  সেজে থাকা পাহাড়।  সবুজ গাছপালা ।  দূরে সবুজের চারণভূমি। পরিকল্পনা মাফিক সেজে উঠেছে  বহুজাতিক সংস্থার অফিস । সারা পৃথিবীর অফিসের মিলনক্ষেত্র এই দেশটা । 

শীতকালে সাদা বরফের মাঠে চলে শীতকালীন গেমস ।  ইভেন্টগুলির মধ্যে রয়েছে স্নো স্কিইং, স্নো রাগবি, স্নো আইস স্টক, স্নো বেসবল, স্নো মাউন্টেনিয়ারিং আরো নানান খেলা  । স্নো স্কিইং এই দেশে খুব জনপ্রিয় । নানান দেশ থেকে ক্রীড়া প্রেমীরা চলে আসেন  এই দেশে  ।  

ভাদুর শহর 

ভাদুজ এর পার্লামেন্ট হাউস এর পাশেই রয়েছে পর্যটন দপ্তর । বিভিন্ন সুবিনের দিয়ে সাজানো সেই দপ্তরে পৌঁছতে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে আমার হাতে তুলে দেয়া হলো তাদের দেশের জাতীয় পতাকা । তাদের দেশ সম্বন্ধে আমাকে অনেক কিছু জানালেন । অফিস থেকে বাইরে বের করে এনে দেখালেন পাহাড়ের মাথায় একটা ক্যাসেল  সেখানেই থাকেন পৃথিবীর ধনীতম রাজা।  আর একটা কথা আমায় বললেন : রাইনের ওপরে পুরানো একটা ব্রিজ আছে । "আল্টে রাইনব্রেক" একটি কাভার্ড কাঠের সেতু যা ভাদু এবং সিভেলেনের পৌরসভাগুলিকে যোগ করে রেখেছে । ১৩৫ মিটার দৈর্ঘ্য এটি । ১৯০১ সালে শেষ হয়েছিল এবং আজ রাইনটি জুড়ে থাকা কেবলমাত্র সেই কাঠের সেতু রয়ে গেছে । মোটর গাড়ি সেতুর ব্যবহারের অনুমতি দেয় না, এটি সাইকেল আরোহীদের কাছে বিশেষত জনপ্রিয় । পারলে দেখে আসুন খুব ভালো লাগবে । সময়ের অভাবে আমি যেতে পারিনি ।

দূরে আজ পর্বতমালা 


পর্যটন দফতর থেকে বেরিয়ে চলে যাই ১৭  শতকের একটি পুরনো চার্চ দেখতে । একটু এগিয়ে এলেই  চার্চ । সামনে রাস্তাটাও  ছবির  মতো । আকাশের দিকে তাকালেই চোখে পড়ে একটি ক্যাসেল বা দুর্গ । জানিনা কবি রাইনের মারিয়া রিলকে এখানে বসে কবিতা লিখেছিলেন কিনা ? একটা মিস্টিক বা রহস্যময় আঙ্গিক রিলকের লেখার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তার 'দুইনো এলিজি' ছিলো একটা দুর্গে বসেই লেখা । এটা আসলে  গুটেনবার্গ ক্যাসেল । প্রায় ৭০মিটার উপরে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে, বিল্ডিংয়ের কাছে অনেক আকর্ষণীয় প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার করা হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য - 'মার্স ভন গুটেনবার্গ' মূর্তি মাত্র ১২ সেন্টিমিটার । যা এখন লিচটেনস্টাইন জাতীয় জাদুঘরে রাখা আছে । গাছগাছালিতে ঢেকে থাকা স্তব্ধতার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন চার্চটি । চার্চটিতে  যাওয়ার পথে নানা ভাস্কর্যে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । ভাদুজ  লিচটেনস্টাইনের মাঝখানে স্পন্দিত হৃদয়।  ভাদুজে ছয়টি বড় যাদুঘর রয়েছে।  প্রাচীন এবং আধুনিকের একটা সমন্বয় ঘটেছে এই মিউজিয়াম গুলোতে । কেন শিল্প হবে না? সেতো নিজেই শিল্পর আকার ধারণ করে বসে আছে । শহর যদি শিল্প হয় তবে তার মাটিতে কেন থাকবেনা শিল্পের সম্ভার? যে দিকে তাকাই সেটাই ছবি । মেঘ বালিকারা ঘুরে বেড়াচ্ছে আল্পসের মাথায়  । শহরের ঘরবাড়িগুলো এমনভাবে সাজানো যেখান থেকেই দাঁড়ান না কেন আপনি আল্পসকে দেখতে পাবেন। পৃথিবীর ধনী দেশের মধ্যে অন্যতম ধনী দেশের আরেকটি বড় উৎস ডাক টিকিট বিক্রি করা । ডাকটিকিটের মিউজিয়ামটি বেশ বড় । সেখানেও অনেকটা সময় আমরা কাটালাম । 

শপিং মল 


পায়ে হেঁটে দেশটাকে ঘুরে নিয়ে ভাবছি  দুটো দিন থেকে গেলে হতো না ? বিধিবাম । বাস রেডি চলে যেতে হবে অস্ট্রিয়া ।

কী ভাবে যাবেন : এই দেশে কোন বিমানবন্দর নেই । আপনাকে আসতে হবে , ইউরো এয়ারপোর্ট হয়ে। যেটি সুইজারল্যান্ডের ব্রাসেলে। হাইওয়ের ধারে এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে । 



চারিপাশে ভাস্কর্য 

কোথায় থাকবেন : ভাদুজে বেশ কয়েকটি ভাল হোটেল আছে।তার মধ্যে রাস্তার ধারে ভাদুজ রূফ। পার্ক হোটেল । সেন্টার বাই রেসিডেন্স হোটেল । প্রতি রাতের ভাড়া ১২০০০ থেকে ১৮০০০  হাজার টাকা ভারতীয় মুদ্রায় ।

এই দেশে প্রবেশ করার জন্য আলাদা করে কোনো ভিসার প্রয়োজন হয় না । শেনজেন ভিসা থাকলেই আপনি প্রবেশ করতে পারবেন ॥ 



মন্তব্যসমূহ

  1. শহরটা ঘোরা হয়ে গেলে । খুব সুন্দর

    উত্তরমুছুন
  2. গল্পটা পড়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল ভাদুজ, অসাধারণ লেখনী।

    উত্তরমুছুন
  3. খুব সুন্দর ভাবে ভ্রমণ হলো।

    উত্তরমুছুন
  4. খুব ভালো লিখেছেন। আপনার অনেক লেখাই আমি পড়েছি, প্রতিটি লেখাই অসাধারণ।
    বিভিন্ন পুঁথি থেকে যেমন জ্ঞান অর্জন করেছেন, তেমনি শিক্ষা অর্জন করেছেন বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। সার্থক হোক আপনার জীবন।

    উত্তরমুছুন
  5. পৱলাম ভালোলাগলো,,,
    সুন্দৱবন থেকে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম