আন্দামানে এলিফ্যান্টা বিচ ও ভয়ের কারখানা

 এলিফ্যান্টা বিচ ও ভয়ের কারখানা

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় 

 আমরা যে যার নিজের মতো করে ঘুরবো । কয়েকজন আবার বললেন সূর্যাস্ত দেখতে যাব রাধানগর বিচে। কেউ আবার কালাপাথর বিচে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করলো । হঠাৎ একটা ওয়াটার প্লেন হ্যাভলক এসে নামল । ওটা দেখার জন্য আর ছবি তোলার জন্য সকলে ঝাপিয়ে পড়লো । সব পরিকল্পনায় এদিক ওদিক হয়ে গেল । আমার ইচ্ছে ছিল এই বিমানে একবার পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরব । সকাল থেকে রাধানগর বিচে স্নান করে সকলেই প্রায় ক্লান্ত । ঘড়িতে তখন তিনটে বাজে । ঘুম ঘুম পাচ্ছে দেখে একটু চা খেয়ে নিলাম । হঠাৎ দেখি কেয়া দি হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে আমায় বল্লেন দাদা আমরা এলিফ্যান্টা বিচ যাব না? পেছনে দেখি সুস্মিতা দিদিমণি।এনারা দুজনেই একই স্কুলের শিক্ষিকা ।


এলিফ্যান্টা বিচ যাওয়ার একটা রাস্তা আছে সেটা হলো রাধানগর বিচ থেকে ট্রেক  করে যেতে হবে। সে খুব কষ্টকর ট্রেক আর তিনটের পর তো যাওয়াই যাবে না ।সেখানে যেতে গেলে একজন গাইড এর প্রয়োজন হয় । রাস্তায় খুব বাজে । কি করব বুঝতেই পারছি না ।এলিফ্যান্টা বিচ হ্যাভলোক দ্বীপের দক্ষিণ পূর্ব দিকে।  সবুজ নীল আশ্চর্যজনক পরিষ্কার জলে অসংখ্য  প্রবালের সাথে সাদা বেলে পাথরের কোস্ট লাইন। এলিফ্যান্টা সমুদ্র সৈকত হ'ল জল ক্রীড়া এবং স্নোর্কেলিং জন্য বিখ্যাত । বিদেশিদের কাছে খুব জনপ্রিয় এলিফ্যান্টা সমুদ্র সৈকত। 

পেছনে তাকিয়ে দেখি তপনদা হাজির । সঙ্গে তন্ময়, (তপনদার ছেলে ) ও বৌদি । তপনদা হুজুগে লোক । চিৎকার করে বলল : এই চলত এলিফ্যান্টা যাব । আমরা ছয় জন হয়ে গেলাম । এই বিকেলে কোন বোট যেতে রাজি হচ্ছিল না।আমার পরিচিত একজন মানুষ ছিলেন তাকে বলতে সে একটি স্পিড বোট জোগাড় করে দিলেন । বোটে উঠতে যাচ্ছি এমন সময় শেখর দা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বললেন আমিও যাব । আমরা ৭ জন উঠলাম সেই বোটে। আমাদের প্রত্যেককে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দেয়া হলো । 


আমাদের যাত্রা শুরু হলো শান্ত সমুদ্রের জলের উপর দিয়ে । তারপর আস্তে আস্তে গভীর সমুদ্রর দিকে রওনা হলো । পিঠের শিড়দাঁরায় যেন  হঠাৎ করে একটা স্রোত বয়ে গেল । স্পিড বোর্ড ট্যাক্সি তার শক্তি দেখাতে শুরু করলো । উত্তাল সমুদ্র তরঙ্গে ঝাপিয়ে পড়লো আমাদের বোট । সুবিশাল পৃথিবীর মাঝে একটু পরেই যেন আমরা হারিয়ে যাব । সমুদ্রের ঢেউ আমাদের ভাসিয়ে দিচ্ছে । বোট  ঢেউয়ের উপরে উঠে আবার আছড়ে  পড়ছে নিচেতে । আমাদের হৃদপিণ্ডে যেন রক্ত চলাচল বন্ধ । স্পিডবোর্ড যখন ওপর থেকে নিচে পড়ছে তখন ধপাশ করে একটা শব্দ হচ্ছে ,সেই শব্দ আমাদের বুকের ভেতর আটকে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে যেন আমরা সুনামির জলে আটকে গেছি সমুদ্র আমাদের পেচিয়ে তার নিজের গহবরে নিয়ে যাবে । টানটান উত্তেজনা থেকে শুরু হলো মৃত্যুভয় । তপনদা তার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে কান্নার রোল তুলেছে । একে অপরকে আঁকড়ে ধরেছে । কেয়া দিদিমণি সুস্মিতা দিদিমনির দুটো হাতকে চেপে ধরে অঝোরে কাঁদছেন আর বলছেন :  আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে চলো । আমার বুকে তখন পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ । চালক সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন । একটা করে ঢেউয়ের ওপর থেকে যখন শূন্যে  ভেসে  নিচে নামছে স্পিড বোট, কান্নার রুল বেড়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটার শব্দ, একটু পরেই যেন আমরা মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাব । জলের ঝাপটায় সকলেই আমরা সমুদ্রস্নাত। জামাকাপড় ভিজে সপসপ করছে । দুটো নোনাজল একাকার হয়ে গেছে । এক সমুদ্র জল আর চোখের জল । একজন বলছে কেন নিয়ে এলি ? একজন বলছে, আমার বাড়ির লোককে কি আর দেখতে পাবো না ? শেখর দা ভয়ে গুটিয়ে আছে , সুস্মিতা দিদিমণি ভয়ে মিটিমিটি হাসছে ! আমার আশ্বাস দেওয়ার কোন শব্দ নেই । কেননা মনে হয়েছিল আমিও মৃত্যু পথের যাত্রী। শুধু নির্বিকার আমাদের চালক। জলের শক্তির সাথে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সে আরো জোরে গাড়ি চালাতে শুরু করলো ।  দু মিনিট অন্তর ৩ ফুট ৪ ফুট  আমরা ভেসে থাকছি শূন্যে । উত্তাল সমুদ্র , ভয়ঙ্কর কালাপানি যেন দানবের রূপ নিয়েছে ! ৪০ মিনিট এভাবে চলার পর আমরা এলিফ্যান্টা বিচে এসে থামলাম । কারুর আর শক্তি নেই বোট থেকে নামার । একটু থিতু হবার পর আমরা বিচে নামলাম । বিচে নেমে কয়েকজন শুয়ে পড়লেন । সকলেই ভাবছেন এ যাত্রায় হয়তো বেঁচে গেলাম । জলে নেমে কোরাল দেখার ইচ্ছে আর কারুর নেই । ফিরতে হবে এই পথ দিয়েই । সকলেই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি সমুদ্রের দিকে । 


মন্তব্যসমূহ

  1. বাহ বেশ শিহরণ জাগানো ভয়ের নৌকো যাত্রার বিবরণ।

    উত্তরমুছুন
  2. বাহবা বাহবা বাহ্ বাহ ............ যথার্থ এ বর্ণন। হাড় হিম করা। স্নায়ুতে একটা ছড়া স্রোত রাখতে পেরেছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। এখনো ভেবে ঠিক করতে পারছি না, এরপর যখন আবার হ্যাবলক রাধানগর যাবো, এলিফ্যানটা যাবো কি না ! এখনো শিহরণ থামে নি যে !..........

    উত্তরমুছুন
  3. দারুন লেখা।আগে পড়েছি,আজ আবার পড়ে আন্দামান ভ্রমণের স্মৃতি তাজা হয়ে গেলো।।

    উত্তরমুছুন
  4. দারুন লেখা /ভয়কে জয় করে ফেরার পরে যে অভিজ্ঞতা ,যে আনন্দ তা অপরিমেয়,তার স্বাদই আলাদা /এ স্বাদের ভাগ হয় না /

    উত্তরমুছুন
  5. দম বন্ধ করে পড়লাম।তারপর কি হল?

    উত্তরমুছুন
  6. সেদিনের সেই রোমহর্ষক সমুদ্র যাত্রার এক সহযাত্রী আমি, কেয়া দি।আপনার লেখা পড়ে সেদিনের সেই রোমাঞ্চকর , শিরদাঁড়া কাঁপানো অনুভূতি যেনো আবার ফিরে এলো।এও জীবনের এক সঞ্চয়।অতল,উত্তাল সমুদ্রে একটা ছোট নৌকায়,আমরা কজন অসহায় মানুষ অজানার অপেক্ষায় ।তোর মধ্যে আবার মাঝ সমুদ্রে স্পীড বোটের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেলো,......মৃত্যু নিশ্চিত।
    কি ভাবে ফিরে এলাম না!

    উত্তরমুছুন
  7. আপনার লেখা আমার খুব খুব ভালো লাগে। খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করেন আপনার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। আপনার আগামী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।

    উত্তরমুছুন
  8. খুব সুন্দর বর্ণনা। ভাল থাকবেন।

    উত্তরমুছুন
  9. দারুন সুন্দর এক রোমহর্ষক বর্ণনা l

    উত্তরমুছুন
  10. দারুন একটা প্রোজেক্ট। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ তোমাকে।

    উত্তরমুছুন
  11. সুন্দরের টানে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা....

    উত্তরমুছুন
  12. খুব সুন্দর একটা ঘটনা। ফেরার সময় কি হলো জানতে পারলাম না।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম