বদ্রীনারায়ণে মহাভারতের গ্রাম

 মহাভারতের গ্রাম

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় 

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল নীলকন্ঠ| শীতে শহর জড়সড় হয়ে থাকলেও সবুজ পাহাড় আর রুক্ষ পাহাড়ের নৈসগিক দৃশ্যের মাঝে খরস্রোতা অলকানন্দার একদিকে নর অন্যদিকে নারায়ন পর্বত| তার মাঝে বদ্রীনাথের বড় আকর্ষণ নীলকন্ঠ. বরফের পাগড়ি জড়ানো ২১০০০ ফুট পর্বতের মাথায় বসে আছেন চতুর্ভুজ বিষ্ণু। যে পর্বত বহুকাল ধরে রহস্যে ঘেরা ছিল, বিদেশীরা সাতবার চেষ্টা করেও তাকে জয় করতে পারেননি তার মাথায় চেপে বসেছিল রাজস্থানের এক স্কুল শিক্ষক ১৯৬১ সালে| বদ্রীনাথ থেকে পাঁচ কি.মি. দূরে  নীলকন্ঠ ।  কিন্তু দেখে মনে হয় হাতের কাছে । পাহাড়ের তলায় আছে ব্র্ক্ষ্মপাল । গয়ার মতো এখানেও পূর্বপুরুষের জন্য তর্পণ করেন অনেকেই । শুনেছি চতুর্ভুজ বিষ্ণু ভক্তপ্রাণ  মানুষদের নাকি দেখাও দেন! কুম্ভযোগে অনেকেই নাকি নীলকন্ঠ পর্বতে তাঁকে দেখতে পান! ঘন্টার পর ঘন্টা যাকে দেখেও তৃপ্ত হওয়া যায় না। সেই শৃঙ্গকে আড়াল করে রেখেছে বদ্রীর দুই পাহাড় কৃষ্ণ আর অর্জুন । অলকানন্দার সেতু পেরিয়ে বদ্রীনাথের মন্দির।  এখানকার তপ্তকুন্ড ও নারদকুন্ড তো মহাভারতের পাতা ধরেই | বরাহ এবং হিরন্যাক্ষ যুদ্ধের কথা সবার জানা । হিরন্যাক্ষকে বধ করে বরাহ বদ্রীনাথে পুজো দিতে আসেন । প্রায় ১২০০ বছর আগে শঙ্করাচার্য একটি কুলগাছের তলায় বদ্রীনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।  এর আগেও অবশ্য মুনি, ঋষি, দেবতা বা অন্য গ্রহের মানুষরা এখানে থাকতেন! তারা না থাকলে ১০২৪৪ ফুট উঁচুতে শঙ্করাচার্য আসতেন কীভাবে?

বদ্রিনারায়ান মন্দির 


আমাদের গন্তব্যস্থল, ভারতের শেষ গ্রাম মানা । এক সময়  খুব কম লোকজনই বদ্রীনাথ থেকে মানা গ্রামে যেতেন ।  বদ্রীনাথ থেকে তিন মাইল দূরে  মানা গ্রাম | অদূরেই চীন সীমান্ত। সারা গ্রামটিকে ঘিরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা।  গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সরস্বতী নদী। সুন্দর পিচের রাস্তায় প্রাইভেট গাড়িও যাচ্ছে।আমরা গিয়েছিলাম হেঁটেই | লাগে ঘন্টাখানেক ।

সরস্বতীর নদী পার দিয়ে এগোলেই মানা গ্রাম পৌঁছানো যায়।  হেলিপ্যাড পেরিয়ে গ্রামের সীমানা।  ঢুকতেই দেখা যাবে মানুষজন সব মিলিয়ে হয়তো শ’খানেকও হবে না| স্কুল থেকে একটু এগোলেই একটি মন্দির। এই গ্রামের মানুষ এটিকে ঘণ্টেশ্বরীর মন্দির বলেন।  মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী অনেকটাই বৌদ্ধ শিল্পশৈলীর মতো।  দেবীমূর্তির কানে বড় বড় ঘন্টা। এখানকার মানুষের বিশ্বাস, এই দেবী মিথ্যে কথা শুনতে চান না। ।  মিথ্যে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বেজে ওঠে ঘন্টা তাই এই দেবীর নাম ঘণ্টেশ্বরী। পাহাড়ের ধাপে ধাপে বাস করা বেশিভাগ মানুষই ভেড়া চড়ান। আর বাড়িতে ভেড়ার লোম দিয়ে পশমের জিনিস তৈরি করে। এদের তৈরি কম্বল ও কার্পেট অতি লোভনীয়। এখানকার মানুষের সঙ্গে চীন দেশের মানুষের সাদৃশ্য চোখে পড়ে।  এরা একসময় চিনের সঙ্গে বানিজ্য করত । এরা নিজেদের মার্চা বলে । পুরানে এদের গন্ধর্ব জাতি বললেও এরা নিজেদের চীন দেশীয়দের বংশধর বলে। । কেউ কেউ আবার নিজেদের ‘বুর্গিয়ান’ বলে।  মানা থেকে আরও ২ কি.মি. এগোলেই ভীমপুল ।   আর পাশেই ব্যাসগুম্ফা। এই পথ ধরেই একসময় চীন দেশের সঙ্গে এরা বাণিজ্য করত। বৌদ্ধরা মনে করেন বদ্রীনাথের মূর্তি একটি বুদ্ধমূর্তি। তিব্বত থেকে এই মূর্তি এনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। গ্রামবাসীদের কাছে শুনেছি, মাঝে-মাঝেই এরা ভেড়া নিয়ে ভারত-চিন সীমান্ত রেখা অতিক্রম করে ফেলে॥

নীলকন্ঠ মহাদেব 


মানা গ্রাম আর ব্যাসগুম্ফার মাঝে মানুষের বসতি নেই।  সরস্বতী নদীর ধারেই ব্যাসগুম্ফা। পাশাপাশি দুটি গুহা।  এখন দুটোই পরিতক্ত। একটি গুহায় ব্যাসদেব অন্য গুহায় গনেশ বাস করতেন।  এই গুম্ফায় বসে গনেশকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাসদেব রচনা করেছিলেন মহাভারত।  রুক্ষ, পাথরের মাঝে দু-একটি বার্চ গাছের ছালেই ব্যাসের মহাভারত লেখা হয়েছিল। ব্যাসগুম্ফা থেকে একটু দূরেই ভীমপুল। সরস্বতী নদীর ওপর একটি বিশাল পাথর দিয়ে এই সেতু তৈরি হয়েছে। চারপাশে রেলিং দিয়ে ঘেরা ।  ভ্রমনার্থীরা দুদন্ড জিরিয়ে নিতে পারেন ভীমপুলে।  এই সেতু তৈরি করেছিলেন নাকি ভীম স্বয়ং। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর মহাপ্রস্থানে গিয়েছিলেন পঞ্চপান্ডব এই পথ ধরেই । মহাপ্রস্থানে যাবার সময় এই সরস্বতী নদী পাঁচ ভাই অতিক্রম করলেও দ্রৌপদী অতিক্রম করতে পারছিলেন না।  ভীম তখন একটা পাথর নদীর ওপর ফেলে সেতুবন্ধন করেছিলেন।  মনে হয় যেন, সরস্বতী নদীর উৎস এখানেই| আর্যরা ব্র্ক্ষ্মবর্ত নামক স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করলে সেই স্থানের নদীবিশেষে এই নাম দেন।  মহাভারতে উল্লেখ আছে, এই নদীর তীরেই ঋষিদের আবাসস্থল ছিল।  সারাবছর এখানে বেদধ্বনি হত বলে বাগদেবীর বাসস্থান বলে পরিচিত।  সরস্বতী নদীর ওপর ভীম যে সেতু তৈরি করেছিলেন তার নিদর্শনও দেখা যায়।  ভারি পাথর তুলতে গিয়ে ভীমের পদযুগল মাটিতে বসে যায়।সেই যুগলের ছাপ আজ পাথর হয়ে গেলেও ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে তার মাহাত্ম্য অনেকটাই।

মনোগ্রাম 


দূরে মানা গ্রাম আর বদ্রীনাথ শহরটাকে বিন্দুর মতো দেখা যাছে। খালি চোখে নীলকন্ঠকে দেখা যায় না।  ভীমপুল পার হবার পর সঙ্গীরা আর যেতে চাইল না। এই পথই গেছে ছোটবেলায় পড়া আটে-অষ্টবসুর সেই তপস্যার স্থান বসুধারায়। বসুধারার এত কাছে এসেও দেখা হবে না? বান্ধুদের বহু অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা না যেতে চাওয়ায় একলা পথ হাঁটা । একা যেতেও মন চায় না আবার না গেলেও দুঃখ বাড়বে, এটা বুঝতেই নীলকন্ঠকে সামনে রেখে চলতে শুরু করলাম । স্বর্গযাত্রার পথ তো দুর্গম হবেই । চড়াই-উতরাই ভাঙছি আর এগিয়ে চলেছি । মানা গ্রাম ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। নীলকন্ঠ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে ।  রাস্তা চিনতে কোনও কষ্ট নেই ।

  দূরে পাহাড়ের মাথায় বরফের চাদর । নীলকন্ঠ অদৃশ্য।  মাঝে-মাঝেই অজানা ভয় আর শ্বাস-প্রশ্বাসের কষ্ট। প্রায় চার কি.মি. পথ সঙ্গীহীন হওয়াতে অজানা ভয় আঁকড়ে ধরছিল । রাস্তা ঠিক আছে তো? ঘন্টাতিনেক পর বসুধারার শব্দ শোনা গেল । অবশেষে বহু প্রতিক্ষায় বসুধারা দেখা দিলেন ।  ৪০০ ফুট ওপর থেকে ফেনার মতো গড়িয়ে নামছে জলের ধারা। পড়ছে বরফের চাই-এর ওপর। বদ্রীনাথের ধর্মপ্রাণ মানুষের ‘পাপীদের’ গায়ে বসুধারার জল পড়ে না ।  মহাভারতের গল্পে আছে, বশিস্ট মুনির অভিশাপে দক্ষকন্যা বসুর গর্ভে বহুরুপ, ত্র্যম্বক, সাবিত্র, দ্যূ , সুরেশ্বর, জয়ন্ত, পিনাকী, অপরাজিত এই আট ভাই পাপমোচনের জন্য তপস্যায় বসেছিলেন এখানে । ঠান্ডাকে উপেক্ষা করেও বসুধারে বহু মানুষ স্নান করেন । বদ্রীনাথ থেকে সকালে বেরিয়ে বসুধারা ঘুরে ফিরে আসতে সময় লাগে ৮ ঘন্টা ।

মানে গ্রামের শিশুরা 


বসুধারা নেমে এসেছে বাদিক দিয়ে আর ডানদিকে পাহাড়| সামনে কয়েক মাইল ফাঁকা জায়গার মধ্যে দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে নদী । বহুদূরে দেখা যাচ্ছে বরফে মোড়া কিছু শৃঙ্গ। একটা পথের রেখা।  চলে গেছে । এই পথই গেছে অলকাপুরীর দিকে । অলকাপুরী থেকে আরও ৫ মাইল গেলে শতপন্থ লেক ১৪৪০০ ফুট উঁচুতে| অলকাপুরী থেকে কিছুটা দূরেই  মানা গিরিসংকট, মানা গিরিসংকট দিয়েই যেতে হত মানস সরোবর । মানা থেকে শতপন্থ লেক যেতে দুদিন সময় লাগে।  


ছবি : তাপস কুমার দত্ত

মন্তব্যসমূহ

  1. তথ্য সম্বলিত লেখা। অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  2. মনে হচ্ছে সফেন বসুধারাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি

    উত্তরমুছুন
  3. আপনার লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। আগামী ভ্রমণ কাহিনীর অপেক্ষায় থাকলাম ❤️

    উত্তরমুছুন
  4. খুবই ভাল লাগল আপনার লেখা।

    উত্তরমুছুন
  5. এতো সুন্দর ভ্রমণ কাহিনী এর আগে কখনো নজরে আসেনি।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম