কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ
রূপলোকের_প্রেম_ও_বরফ_যাত্রা॥
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় ।https://www.blogger.com/blog/post/edit/4648867467379144629/7601792051529929973
নেহেরু প্রধানমন্ত্রী হবার পর হিমাচল প্রদেশের কিন্নর জেলায় পাঠিয়েছিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়নকে । কেন ? না সে প্রদেশের মানুষের উন্নতি সাধনের জন্য কী কী করা যায় সেটা দেখতে । ফিরে এসে রাহুল সাংকৃত্যায়ন অসাধারণ একটি বই লেখেন কিন্নর দেশে । বইটি পড়ার পর মনে হতো কবে যাবো ? কবে যাবো ? এমনকি ব্যাগ গুছিয়ে ফেলেছিও ভেবে ফেলতাম । প্রথম যে বার গেলাম কষ্টের সীমা-পরিসীমা ছিলোনা । সিমলার লক্কর বাজার থেকে বাস ছাড়বে ভোর বেলা যাবো সাংলা। দিনে দুটো বাস । সেসব কষ্টর কথা আজ শুনতে বেমানান লাগবে ।শুধু একটা কথা বলি সহযাত্রীর বমিকে নিজের গায়ে মেখেই যাত্রা করতে হবে ।
কল্পার পথে |
আমার চোখে এসব কিছু নেই । আমার চোখে অনন্ত দেবভূমির একটা প্রতিমা(ইমেজ ) ভেসে বেড়াছে । এই তো সে দেশ , যেখানে দেখা মেলে অনন্ত প্রকৃতির । এইতো সেই দেশ , যেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে পরীর দল নেমে আসে আপেলের বাগানে ! নৃত্য আর সংগীতে মুখরিত হয়ে ওঠা সুর পাহাড়ের গা দিয়ে বয়ে নেমে আসে নদীর দু'ধারে।
কল্পনা আর বাস্তব যেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে
কিন্নরের স্পর্শ তার প্রতিটি মুহূর্তের হাতছানি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে কে? এত মানস ভ্রমণের সঙ্গে বাস্তব ভ্রমণের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। হিমালয়ের গহনে নীল আকাশের বুক চিরে মেঘেদের কারখানার আনাগোনা বাঁশি হাতে ছোট্ট মেয়েটি দেবদারু পাতার সুরে সুরে সুর মেলাচ্ছে । এখানে কেউ আলাদা করে গান রচনা করেনা, উৎসবের মাঝে সুর জেগে ওঠে। সবকিছুই যেন ছন্দে চলেছে। গাড়োয়াল হিমালয় এর সঙ্গে কিন্নর জেলার পাহাড়ের সাদাচোখে কোন পার্থক্য নেই। একইরকম পাহাড়, একইরকম নদী, সেই পথের বাঁক। তবে কি পার্থক্য? ভারতের কোন রাজ্যের নারী ও পুরুষ একই রকম টুপি সারা বছর সারা দিন কেউ পড়ে থাকে না । কিন্নরের গহনতার মধ্যে স্তব্ধতা। নৈশব্দের তর্জনী তুলে দিলেও ভেঙে যেতে পারে স্তব্ধতা।
পৃথিবীর দ্রুততম বহতা নদী শতদ্রুর বাম তীর ধরে চলেছে যে তারই প্রান্ত ধরে রাস্তায় এগিয়ে চলেছে সাংলার দিকে ।
একপাশে হিমালয়ের দীর্ঘতম , বৃহত্তম দেওদার বনানী।
লোকায়ত প্রাপ্তির কিংবা পরমার্থিক লাভের কোন জটিল চেতনা না থাকায় এই যাত্রা পথ অনেক মোহময়। দেওদার জঙ্গল ছাড়াও চির গাছ , পাইন গাছ , সাইপ্রিস সহ বহু সরলবর্গীয় গাছের ছড়াছড়ি। ক্যামব্রিয়ান যুগের শিলাস্তর গঠিত এই পাহাড় শ্রেনী । হিমালয়ে যে নানান ধরনের বিবর্তন ঘটেছে, সেই বিবর্তনের একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ মেলে কারছাম থেকে ছিটকুল পর্যন্ত রাস্তার প্রতিটি অঞ্চলে ।
কারছাম থেকেই রাস্তা দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে । ভাগ যেমন রাস্তা হয়েছে , মিলন হয়েছে দুই নদীর। শতদ্রু আর বাসপা নদী একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এই মিলনস্থলের পরেই সুন্দর এখানে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে । সাংলার খ্যাতি তার উপত্যকার জন্য, যতদূর চোখ রাখা যায় শুধুই উপত্যকায় ঘেরা।
কারছাম থেকে মোড় নিয়ে গাড়িটা যখন উপর দিকে উঠতে থাকে , তখন আর বাইরের দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না। অসাধারণ সেই নৈসর্গিক দৃশ্য। ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে বাসপা নদী।
সারাহান থেকে |
পাহাড়ের মাথায় গাড়িটা উঠছে যেন আলপথ দিয়ে । ক্রমশ বাসপা নদীর রেখাটা সুতোর মতো নীল হয়ে যাচ্ছে।
যাদের হৃদয় দুর্বল তাদের বাইরে না তাকানোই ভালো।আমার সঙ্গে যিনি যাচ্ছিলেন, ভয়ে তিনি বাসের সিট থেকে নেবে বাসের ভেতরে বসে পড়লেন । ৮৫০০ ফুট উঁচুতে সাংলা জনপদে পৌঁছবার পর মনে হবে প্রাচীরে ঘেরা এক দুর্গে এসে উপস্থিত হলাম। নীল আকাশের নিচে সাদা পুরো বরফ । বরফ এর গায়ে রুক্ষতা । সবুজের নামগন্ধ নেই , নদীর ধারে সবুজ । এখানে রাজা বীরভদ্র একটি দুর্গ বানিয়েছিলেন । স্থানীয় লোকজন বলেন, কামরূপ ফ়োর্ট । আবার কেউ কেউ বলেন , অসমের কামরূপ থেকে নাকি দেবতার একটি অংশ এখানে আনা হয়েছে। এনিয়ে অনেক গল্প আছে । লতিয়ে ওঠা আঙ্গুর গাছ, আখরোট গাছ আর আপেলের বাগানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া যায় কামরুপ ফ়োর্ট। দূরে কিন্নর কৈলাস কৈলাস মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর পাশে পিন পার্বতীর পার্বতী একটুখানি মুখ দেখাচ্ছে। পৌঁছেছি তখন একটু খানি লাল আলো দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায়। সাদা বরফের চাদরে মোড়া পাহাড়। যাহোক করে হাত মুখ ধুয়ে চা নিয়ে বসে পড়লাম । তীব্রঠান্ডা , হওয়া দিচ্ছে আর অল্প অল্প করে যেন মনে হচ্ছে বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। রাত ১০টা নাগাদ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। হোটেলের ম্যানেজার এসে বললেন , শুধু বৃষ্টি নয় , তুষারপাত হচ্ছে। মনের মধ্যে ভীষণ আনন্দ । কম্বল থেকে বেরিয়ে এসে দেখতে লাগলাম তুষারপাতের দৃশ্য।সকালে ফের নতুন করে শুরু হল তুষারপাত । মনে হল যেন জীবন সার্থক হয়ে গেল । পাহাড়ে এসে এরকম বরফ পড়া কোনদিন দেখিনি । সেই আনন্দ পরে যে কতটা নিরানন্দ হয়ে উঠল সেটা বুঝতে পারলাম। তিনদিন ধরে বরফ পড়া চলছে। বাথরুমে জল নেই। খাবার জল নেই , হোটেলে খাদ্য নেই । সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন কোন গাড়ি চলছে না গাড়িগুলো বরফের চাদরে ঢেকে আছে। কি করে ফিরব সেটাও জানি না । শুনছি রাস্তার দু চার জায়গায় বিরাট বিরাট ধস নেমেছে অন্ততপক্ষে সাতদিন লাগবে রাস্তা ঠিক করতে । আমরা কল্পা যাবো কি করে ? সে যাত্রায় কল্পা হলো না । ঠিক করলাম যখন নিচে সাতদিনের আগে যেতে পরবো না , তা হলে ছিটকূল দেখিই ফিরবো । সেখানেও বিধিবাম তিনদিন পরে খবর হলো ছিটকুল যাওয়ার আগে একটা বড় সাঁকো ভেঙে পড়ে গেছে। রাস্তায় এত বরফ যে গাড়ি কোনভাবেই যেতে পারবেনা। কি করি ভাবছি আজাদ কাশ্মীরে ঘুরে আসি । আপেলের গাছে পাতা নেই । যে আপেল দেখার জন্য সেপ্টম্বর মাসে মানুষ আসেন । সেই গাছ গুলো দেখে মনে হচ্ছে কালকেই মরে যাবে !
ভীমাকালী মন্দির |
বসপা নদীকে সঙ্গী করে আরো তিন কিমি দূরে। গাড়ির রাস্তা শেষ। কিছুটা হেঁটেই নীচের দিকে নামলেই বসপা নদীর দেখা পাওয়া যাবে । ছোট্ট সাঁকো পেরিয়ে চলে আসা । চারিদিকে পাইনের সারি। এটাই আজাদ কাশ্মীর গ্রাম। ছোট ছোট গ্রামের বাড়িঘর। প্রতিটি বাড়িকে ঘিরে রয়েছে আপেলের গাছ। সাংলাকে এখান থেকে অসাধারণ লাগে। রাস্তা তৈরির কাজের খোঁজে একদল শ্রমিক এসেছিলেন সাংলায়। তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়। ফলে তাঁরা বসপা নদীর এ পারে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা এই জায়গার নাম রাখেন আজাদ কাশ্মীর। আর একটু পেরিয়ে গেলই তাজা রেনবো ট্রাউট কিনে ফেরা যায় ।
সাংলা যত সুন্দর । রাস্তা ততটাই কঠিন । এর চরিত্র বোঝা মুশকিল । ঝড় নেই , বৃষ্টি নেই হঠাৎ রাস্তায় ধ্বস নেমে গেল পাহাড় ভেঙে পড়েছে। সুন্দর যেখানে ভয়ঙ্কর, হাতছানি ততটাই বেশি হয়। সে যাত্রায় পাঁচ দিনের মাথায় স্থানীয এক গাড়ি চালক আমাদের রামপুর অব্দি দিয়ে গিয়েছিল । রামপুর থেকে আর প্রায় ১৮০ দূরে সিমলা ।
মানস ভ্রমণ হলো। এই বর্ষা ধোয়া দুপুরে, বরফের আস্বাদ তো কম কথা নয়। তার উপর হিমালয় টুরিসম"এর সাথেই যখন এপথে যাওয়া। ভাবনা গড়গড়িয়ে পৌঁছে যায় অসাধারণ রোমান্টিক বর্ণনায়। অসাধারণ।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই
মুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা । ভালো থাকবেন ॥
মুছুন
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর বর্ণনা । আমার 2009 সালের ঐ অঞ্চলের ভ্রমণ স্মৃতীকে স্মরণ করিয়ে দেয় ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনসত্যিই মনে হল যেন জায়গা গুলি চোখের সামনে ভেসে উঠল। বাইরে নদী দুকূল ছাপাচ্ছে, আর চোখে ভেসে উঠছে কিন্নর। অপূর্ব।
উত্তরমুছুনভালো থাকবেন ॥ সুস্থ থাকুন
মুছুনখুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন দাদা। আমার এখনো যাওয়া হয়নি কবে যেতে পারবে কে জানে। করোনা আমাদের জীবনটাকে বরোটা বাজিয়ে দিল। আপনার লেখা পরে মানস ভ্রমণ হয়ে গেল।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা
মুছুনKhub sundor lekha. Non ta jano kothay hariye gechilo muhurter janno
উত্তরমুছুনভালো থাকবেন
মুছুনআপনাদের সাথেই গিয়েছিলাম। লেখাটা অসাধারণ। আবারও যেতে চাই।
উত্তরমুছুনআবশ্যই যাবেন
মুছুনএরকম লেখা পড়তে ভাল লাগে। পড়লেই মনটা ভাল হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আমার পরিবারের সাথে সাংলা-কল্পা-ছিটকুল ভ্রমণের স্মৃতি উসকে দেয়।
উত্তরমুছুনভালো থাকবেন
মুছুনযদিও একবার বেরানো হয়ে গেছে,তবু আরেকবার আপনাদের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে রাখি।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনখুব ভালো লাগল। কষ্ট করলেই কেষ্ট মেলে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনদারুণ লেখা, সকলের সাথে ভাগ করে নেওয়ার এক ভালো পদ্ধতি। শুভেচ্ছা
উত্তরমুছুনভাল থাকবেন
মুছুনখুব সুন্দর লেখা। বাড়িতে থেকেই মানস ভ্রমণ। আর এ পথে তো হিমালয় টুরিসম এর সাথেই গেছি। যদিও সাথে বামা দা ছিলেন না। থাকলে আরো ভালো হতো। তাতেও যা দেখেছি জীবন ধন্য।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
মুছুনকিন্নর আমার স্বপ্নের জায়গা, আপনার লেখার মাধ্যমে আমি আমার স্বপ্নের জায়গাকে খুঁজে পাই, আপনার লেখা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম ❤️❤️
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনঅনেক ধন্যবাদ আপনাকে সেই পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে.. অসম্ভব সুন্দর অভিজ্ঞতা ছিল.. সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর পাহাড় পর্বত, সেই পাহাড়ী এলাকায় উচু সবুজ গাছ গুলি।। নীল আকাশে মাঝে মাঝে সাদা পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘের ঘনঘটা.. এক অপুর্ব স্মৃতি.... অনেক ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন- ছন্দা পাল
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
মুছুনখুব সুন্দর বর্ণনা l আপনার লেখা পড়ে কিন্নর, কল্পা, সাংলা যাওয়ার ইচ্ছাটা চগিয়ে চাগিয়ে উঠলো l
উত্তরমুছুনNicely written
উত্তরমুছুনVery good
উত্তরমুছুনThanks
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর লিখেছেন
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনপড়ে আমার নিজের বেড়ানোর দৃশ্য গুলো মনে করিয়ে দিলেন। আমাদের যাওয়া ছিল সিমলা থেকে সাংলা হয়ে কল্পা। সাংলা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই নেমে পড়তে হয়েছিল টাপরি , বিশেষ কারণে। তাতে আরও একটু বাড়তি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছিলাম ভোরবেলাযর দৃশ্য, আর ভোলার নয় গেস্ট হাউসের কেয়ার টেকারের রাতের আতিথেয়তা।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনDuring good
উত্তরমুছুনthanks
মুছুনVery nice picture and writing
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনখুব সুন্দর লেখা আপনার
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনঅসাধারণ লেখনি।
উত্তরমুছুনকবে নিয়ে যাবেন?
নিয়ে যাব। অবশ্যই বলবো ।
মুছুনআপনার লেখনী তে যে স্বাদ,ভ্রমণে গিয়ে সে আস্বাদ পেলাম না।
উত্তরমুছুনNice
উত্তরমুছুনDarun picture
উত্তরমুছুন