রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রথম ভ্রমণ বই

 শিশুদের প্রথম ভ্রমণ বই 


বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় । 

খু্ব কম বাঙালি আছেন যিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজপাঠ পড়েন নি । প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম বই হচ্ছে সহজপাঠ। অ  আ  ক খ শেখার জন্য যেমন সহজপাঠ প্রথম বই তেমনি এটাই বাংলায় লেখা শিশুদের জন্য প্রথম ভ্রমণ বই । সহজপাঠের প্রতিটি পাতায় শব্দ দিয়ে আঁকা আছে ভ্রমণ কাহিনী । 

 সহজপাঠের প্রথম ভাগে বাংলা বর্ণমালা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারনা এবং দ্বিতীয় ভাগে বাক্য, শব্দের ব্যবহার সহজ করে শেখানো। সরল ছন্দের মিশ্রণ এবং শৈল্পিক শব্দের বিন্যাসে শৈশবের চমৎকার সূচনা। নন্দলাল বসুর ছবি ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শব্দমালায় সহজপাঠ, অচিরেই হয়ে ওঠে ছোটদের পড়া পড়া খেলা। আমাদের  পড়তে হয়নি সহজ পাঠ । পড়তে হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের  বর্ণপরিচয়। একটু বড় বয়সে আমি  পড়তে শুরু করি সহজ পাঠ। সহজ পাঠের  আগে আমি পড়ে ফেলেছি রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি । সহজ পাঠ থেকে আমি ছন্দের দুই মাত্রা তিন মাত্রার পার্থক্য বুঝতে শিখেছিলাম । রবীন্দ্রনাথ  ঘুরতে  ভালবাসতেন সারাটা জীবন তিনি দেশ-বিদেশে ঘুরেছেন ।  ঘুরে  এসেছেন ইউরোপ। পুরো দক্ষিণ এশিয়া ঘুরে এলেন ।  রবীন্দ্রনাথ শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরে এসে আর কখনো কোনদিন বিদেশ ভ্রমণ করেনি।তারপরই প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ। তার ভ্রমণের প্রতি অগাধ ভালোবাসাটাও নিখুঁত ছন্দে ভরিয়ে দিয়েছেন সহজ পাঠের পাতায় পাতায়। আমি এই লেখাটি লিখলাম সহজ পাঠের প্রথম ভাগ নিয়ে। 

যে কোনদিন বাইরে বেরোই নি , সে কি করেই বা জানবে ভ্রমণ কি? শিশুমন জানে ঘর থেকে বেরোনো মানেই আনন্দ। মা-বাবার সাথে কিংবা দাদু দিদার সাথে কোলে চেপে একটু ঘর থেকে বের হলেই তার আনন্দ হয়। শিশু মনের বিকাশ তো এখান থেকেই শুরু। ছোটবেলায় মামার বাড়ি যাওয়া টাই মনে হয় সবচেয়ে বড় ভ্রমণ ছিল। কবে থেকে একটা শিশু বুঝল ভ্রমণ কি ? তার স্বাদটা কেমন ?  শিশুমনের স্বপ্ন তৈরি হলো। নিজের ভেতরে দোলা তৈরি হলো মা যখন পড়ালেন  সহজ পাঠের  ক খ  গ  ঘ  গান গেয়ে জেলে ডিঙি চলে বেয়ে । সাথে চরে বসে রাঁধে ঙ । নন্দলাল বসু ছবি এঁকে দিলেন । শিশু মন বলে জেলে ডিঙি কি ? ওরা গান কেন গায় ? চর কি মা ? নৌকার মাঝি-মাল্লাদের গান তো সারি গান।  ভাটিয়ালী গান । আমাদের তো এখনো মনে হয় যে নৌকা করে যাবো , চরে বসবো,  ভাটিয়ালী  গান হবে । ত থ দ  ধ  বলে ভাই আম পাড়ি চলো চাই । রবীন্দ্রনাথ প্রথম আমাদের জঙ্গলে নিয়ে গেলেন প্রথম পাঠ  বনে থাকে বাঘ । গাছে থাকে পাখি । পাখি বনে গান গায় আর পাখা মেলে ওড়ে । এদুটো লাইনই ভ্রমণের পক্ষে যথেষ্ট। শিশুর স্বপ্ন তৈরি হলো পাখা মেলে ওড়ার।পাখা মেলার ছবি এখন মডার্ন ফটোগ্রাফিতে। পাখির ছবি তো  চলছে। ছুটি না পেলে বেড়ানো হয় না । দ্বিতীয় পাঠে এসে প্রথম ছুটির কথা পেলাম । সে ছুটি এক দুদিনের নয়  একদম সাতদিনের ছুটি । রাতে হবে আলো । লাল বাতি । নীল বাতি । চোখে স্বপ্ন ভেসে উঠছে । বেড়াতে যাবার আরো স্বপ্ন এঁকে দিলেন । বায়ু দিকে দিকে ফেরে / ডেকে ডেকে সকলেরে । /বনে বনে পাখি জাগে, /মেঘ মেঘে রঙ লাগে । / জলে জলে ঢেউ ওঠে, । পাহাড়,  সমুদ্র, জঙ্গল এক সাথে বলে দেওয়া কত কঠিন । কিন্তু সে যে  সহজ পাঠ সে তো সহজই ! এটা পড়ার পরই শিশু তার বেড়াতে যাবার একমাত্র জায়গা কি হবে ? সে যাবে মামার বাড়ি । রবীন্দ্রনাথ সেটা জানতেন । আর জানতেন বলেই তৃতীয় পাঠে তাঁকে লিখতে হলো , মামা আনে চাল ডাল । আর কেনে শাক । মামার বাড়িতে একটু লোকজন না থাকলে ভালো লাগে না । আশাদাদাকে নিয়ে এলেন ঢাকা থেকে । মামাবাড়ি গিয়ে তিনি বেড়াতে নিয়ে গেলেন মোতিবিলে । মেঘ চলে ভেসে ভেসে আকাশের গায়, / ঘন শেওলার  দল জলে ভেসে যায় । চতুর্থপাঠে ভ্রমণ বর্ণনা লিখতে শুরু করলেন ।'  চলো ভাই নীলু । এই তালবন দিয়ে পথ । তার পরে তিল খেত । তারপর তিসিখেত । তারপর দিঘি । জল খু্ব নীল । ধারে ধারে কাদা । জলে ঝিলমিল করে ।' পঞ্চম পাঠে তিনি সরাসরি ভ্রমণের কথা বলে দিলেন। 'চুপ করে বসে ঘুম পায় ।  চলো, ঘুরে আসি' । শীত কাল এসে গেছে বাতাসে ছুটির গন্ধ । এই সময় ছুটির দিনে একটা বনভোজন তো আমরা করেই থাকি । সেই সময় বিশ্বভারতী বুধবার ছুটি থাকতো । সেই জন্য  পঞ্চম পাঠে  লিখলেন । আজ বুধবার , ছুটি । নুটু তাই আজ খু্ব খুশি । সেও যাবে কুলবনে । কিছু মুড়ি নেবে আর নুন । চড়িভাতি হবে । এই পাঠের প্রথমে লিখেছেন : আজ খু্ব শীত । কচুপাতা থেকে টুপ টুপ করে হিম পড়ে । ঘাস ভিজে । পা ভিজে যায় । চার বছর বা পাঁচ বছর বয়সে সেই সময় ট্রেনে করে বা বাসে করে যাবার ভাবনা শিশুদের তৈরি হয় না । ভ্রমণটা হয় কাছে পিঠে । কিন্তু ভ্রমণের পরিবেশটা তিনি বারবার তৈরি করেদিচ্ছিন । ঘর থেকে বাইরে পা ফেলার একটা পরিবেশ গড়ে উঠছে ষষ্ঠ পাঠের  প্রতিটি লাইনে লাইনে । শরৎ কাল এসে গেছে হিমের পরশ লেগেছে হাওয়ার ' পরে । ছুটির বাতাস ভ্রমণের বাতাস ছড়িয়ে পড়েছে মনের কোণে কোণে । যে দিকে তাকাই সোনার আলোয়/দেখি যে ছুটির ছবি -/পূজার ফুলের বনে ওঠে ওই /পূজার দিনের রবি। এর চেয়ে ভাল বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন কি হতে পারে? আমরা বেড়াতে চাই যে সময় গুলোতে , ঠিক সেই সময়ের যা যা আমাদের মনের উপাদান দরকার হয় সেই উপাদানের মশাল রবীন্দ্রনাথ দিয়ে গেছেন । শিশুরা যতটা স্কুলে পড়ার জন্য মুখস্থ করছে, বড় হয়ে সেই উপলব্দি আরো প্রগাঢ় হয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ আর থাকতে পারলেন না। ভিতরে ভিতরে তিনি বাইরে বেড়বার জন্য তৈরি ছিলেন। পা বাড়িয়ে দিলেন একদম নৈনিতালে। মৈনি মাসি বৈশাখ মাসে ছিল নৈনিতালে। তাকে যেতে হবে চৈবাসা । তার বাবা থাকে গৈলা । গৈলা কোথায় ?  জানো না ? গৈলা বরিশালে । বরিশাল থেকে তাকে নিয়ে চলে এলেন নৈহাটিতে । বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পরার তাগিদ বারবার মনে করিয়ে দেয় ভ্রমণের কথা । সপ্তম পাঠে শুধু নৈনিতালের কথা নয় ,  সেজে গুজে বেড়িয়ে পরার কথাও কবিতায় বলে গেলেন । দেরি আর সহে না যে, /মুখ  মেজে তাড়া তাড়ি /কত রঙে ওরা সাজে, /চলে আসে ছেড়ে বাড়ি । ভ্রমণ মানে স্বপ্ন,  ভ্রমণ মানে চোখের আরাম, ভ্রমণ মানে বায়ু পরিবর্তন। স্বপ্ন দেখতে না পারলে ভ্রমণে যাওয়া বড় কঠিন কাজ । সেই স্বপ্নও তিনি আমাদের অষ্টম পাঠে দেখিয়েছেন। স্বপনে গেলাম উড়ে মেলে দিয়ে পাখা। আকাশেতে উঠে আমি মেঘ হয়ে গেচি। ফিরিব বাতাস বেয়ে রামধনু খুঁজি,/আলোর অশোক-ফুল চুলে দেবো গুঁজি।/সাত-সাগরের পারে পারিজাত-বনে/জল দিতে চ’লে যাবো আপনার মনে । এবার আর স্বপ্ন নয় নবম পাঠে এসে সরাসরি বলেই দিচ্ছেন পৌষ মাসে যেতে হবে গৌহাটি। গৌহাটির আশেপাশের জঙ্গল পাহাড় সব কিছুকে দেখেছেন তিনি এবং সেই দেখাটা শিশুমনে তিনি দেখাতে চেয়েছেন। তিনি পাখি চিনিয়েছেন। বৌ- কথা -কও 'পানকৌড়ি । অষ্টম পাঠের  প্রতিটি লাইনে রয়েছে ভ্রমণ। পাহাড়-চুড়া সাজে/নীল আকাশের মাঝে,/বরফ ভেঙে ডিঙিয়ে যাওয়া/কেউ তা পারে না-যে।বা সাগর নিয়ে এখানে ছবি এঁকে দিলেন  

জলের ধারে ধারে,/নারিকেলের বনগুলি সব/দাঁড়িয়ে সারে সারে।শেষ লাইনটা যুগান্তকারী শিশু মনের প্রশ্ন : বাবা কেন আপিসে যায়,/যায় না নতুন দেশে? স্বপ্ন যখন মেলে না , বাবা যখন নিয়ে যায় না ভ্রমণে তখন নিজের ভেতরে তৈরি হয় হতাশা । মনে হয় নিজেই চলে যাবো । কভু ভাবি পাখি হয়ে উড়িব গগনে , কখনো হবে না সে কি ভাবি যাহা মনে। সত্যি কি আমি বেড়াতে যেতে পারবো না ? বাবা কি রোজ অফিসে যাবে? এ প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না। বড় হয়ে এই দোলা  নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। 


মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ লেখা, আপনার লেখা পড়ে অনেক মূল্যবান তথ্য জানতে পারি।

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারণ লেখা ..সহজপাঠকে নতুনভাবে দেখলাম..সমৃদ্ধ হলাম..

    উত্তরমুছুন
  3. এত সুন্দর বিশ্লেষণ, সত্যিই।

    উত্তরমুছুন
  4. চমৎকার,প্রাঞ্জল বিশ্লেষণ! অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন
  5. খুব সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন। সহজপাঠ যে এভাবে ভাবা যায় সেটা ভাবিনি কখনো।

    উত্তরমুছুন
  6. খুব সুন্দর লেখা। খুব সুন্দর করে বিশ্লেষণ করেছেন। সহজপাঠ যে এভাবে ভাবা যায় ভাবিনি কখনো।

    উত্তরমুছুন
  7. সহজপাঠ নিয়ে এত সুন্দর লেখা আমি আগে কোনোদিন পড়িনি।

    উত্তরমুছুন
  8. অসাধারণ,সত্যি মনে হচ্ছে সহজ পাঠ যদি হাতের কাছে থাকতো ,নতুন করে শুরু করতাম,মিলিয়ে নিতাম আপনার বিশ্লেষণ।

    উত্তরমুছুন
  9. খুব ভালো লাগলো।মুগ্ধ হলাম।

    উত্তরমুছুন
  10. আরো একটা অনন্য ছন্দে মানস ভ্রমণে বেড়িয়েছিলাম। দেখে এলাম স্বপ্নের আকাশ, বাতাস, পাহাড়, নদী .......। অসাধারণ, ....... সহজ পাঠ""কে এমন সহজ, সুন্দর ব্যাখ্যা এই প্রথম পড়লাম। মৌলিক এবং অনবদ্য।

    উত্তরমুছুন
  11. সহজপাঠের মধ্যে দিয়ে কবিগুরুর শিশুমনকে ভ্রমনে উজ্জীবিত করার প্রয়াসের এত সুন্দর বিশ্লেষণ এযাবৎ কখন‌ও ভেবে‌ও দেখিনি বামাদা। অসংখ্য ধন্যবাদ...ঋদ্ধ হলাম আপনার লেখনীর দৌলতে।
    ডঃঅচিন্ত্য কুমার পোদ্দার।ভিলাই।

    উত্তরমুছুন
  12. অসাধারণ লেখা । এই রকম লেখা আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা ।

    উত্তরমুছুন
  13. কি সুন্দর।নতুন আঙ্গিকে সহজ পাঠকে এত সহজ ভাবে চিন্তা করতে শেখানোর জন্য অনেক অনেক ধন্য বাদ।

    উত্তরমুছুন
  14. অনবদ্য, অতুলনীয়, অসাধারণ

    উত্তরমুছুন
  15. ব্যাতিক্রমী একটা লেখা পড়লাম। সহজ পাঠ এ-র সহজের পিছনে যে অন্তর্নিহিত এক গভীর প্রস্তাবনা রয়েছে - আপনার এই অন্যভাবে দেখার চোখে সেটা প্রকাশ পেল। ভ্রমণ তো সবসময় বেড়ানোর জায়গায় শারীরিক উপস্থিতি দিয়ে হয় না...... কল্পনার মানসভূমিতেও তার অবাধ বিচরণ। সহজ পাঠ এ সেই আপাত লুকিয়ে থাকা কল্পনার উৎসের দিকটা খুব সহজভাবে তুলে ধরেছেন আপনার এই লেখায়।

    আমার কিছু পরিচিত আছেন যারা ফেসবুকে নেই। আপনার নাম সহ এই লেখাটা তাদের পাঠাতে চাই। মতামত জানাবেন।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. খুব সুন্দর আপনার মতামত ॥ অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানবেন । অবশ্যই সকলকে পাঠাবেন ।

      মুছুন
  16. অসাধারন লেখনি আপনার দাদা।

    উত্তরমুছুন
  17. এভাবে কোন দিন ভাবতে পারিনি সহজ পাঠকে। খুব আনন্দ পেলাম।

    উত্তরমুছুন
  18. সহজ পাঠ নিয়ে যে ভ্রমণ কাহিনী লেখা যায়। এবারও বিস্ময়। আমরা কোনদিন এভাবে চিন্তাভাবনা করিনি। এত সুন্দর লাগলো পড়ে। মনে হয় ছোটবেলার সেই সময় ফিরে গেলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম