ভূটান

ভূটান কথা

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় । 

হিমালয় নন্দিনী ভুটান । এই নন্দিনীকে দেখার জন্য এক দশক ধরে বাঙালি বহুবার ভুটানে গেছেন । করোনা পরিস্থিতির জন্য এখন প্রায় সব ভ্রমণ বন্ধ । কিন্তু বাঙালির কাছে ভুটান যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে আরো দু'বছর আগে । ভুটান সরকার চায় না অতিরিক্ত পর্যটক তাদের দেশে এসে দেশটাকে দূষণ ও অপরিচ্ছন্ন করে তুলুক । যার জন্য ভুটান তার বিদেশনীতিতে ভারতীয়দের ক্ষেত্রে ভুটানে প্রবেশের জন্য এমন একটা কর ধার্য করেছেন , তাতে বাঙালির নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে । দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশে ভিসার জন্য মনে হয় এত টাকা লাগেনা। 


আমি ভুটানের বিদেশনীতি নিয়ে কোন কথা বলতে চাই না । সেটা তাদের দেশ । তাদের ভাবনা । কিন্তু পারো থিম্পু হা ভ্যালি বাঙালি পর্যটকদের বড় প্রিয় জায়গা ছিল । একদিকে হিমালয় নন্দিনী অন্যদিকে বিদেশ ভ্রমণ এই দুই আকর্ষণে বাঙালি বারবার ছুটে গেছে ভুটানে ।

ডুয়ার্স কথাটা এসেছে মনে হয় ভুটানকে কেন্দ্র করেই । উত্তরবঙ্গের কতগুলো দরজা দিয়ে ভুটানে যাওয়া যায় তাকে কেন্দ্র করেই ডুয়ার্স । 

আজ আমরা ঝাঁ-চকচকে রাস্তা দিয়ে ভুটানের প্রবেশ করি । একসময় কি ছিল এই ভুটানে ? না ছিল রাস্তা , না ছিল গাড়ি । জহরলাল নেহেরু  প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর একবার ভুটানে গেলেন কি করে জানেন ? ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দিরা গান্ধীকে সঙ্গে নিয়ে ভুটানের পারোতে এসেছিলেন । তখন পারো একটা পাহাড়ি গ্রাম ছাড়া আর কিছুই নয় । সেখানে যেতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আসতে হল গ্যাংটকে। গ্যাংটক থেকে পায়ে হেঁটে তারপর চামরীগাই এর  পিঠে চড়ে তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা হয়ে পারোর পশ্চিমে দ্রুকগেলজং পাশ অতিক্রম করে পারো এসেছিলেন । 

থিম্পু

নেহেরু এত কষ্ট পাওয়ার পর মনে হয় পারোতে গিয়ে ভুটানের রাজাকে বলেছিলেন সড়ক নির্মাণের কথা ।  ১৯৫৯ সালে  ভারতের অর্থনৈতিক সহায়তায় ভুটানের সার্বিক উন্নতি সাধনের অন্যান্য কাজের সাথে ভুটানের সীমান্ত শহর ফুন্ট সিলিং থেকে পারো পর্যন্ত প্রথম রাস্তার কাজ শুরু হয় । 

এর আগে ভারত সীমান্ত থেকে ভুটানে  পৌঁছবার একটা অপ্রচলিত রাস্তা ছিল ।উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার এর কাছে বক্সা দুয়ার থেকে ভুটানের টালা বস্তি চুখা জং হয়ে রায়ডাক নদী উপত্যকা ধরে । ষাটের দশকে প্রথম দিক ভুটানরাজ দার্জিলিং কালিম্পং যেতেন এই পথ ধরেই ।  

আরো একটা পথের কথা বলি হা উপত্যকা হয়ে পারো যাবার পথ ছিল  জলপাইগুড়ি জেলার সীমান্ত জনপদ চামরচি হয়ে । এই পথে দুর্গম গিরি সংকট সেলা-লা পাস অতিক্রম করতে হতো । এই পথ দিয়ে এসেছিলেন আমেরিকার পর্যটক ব্রুট কের টড। সেটা ছিল ১৯৫১ সালে । সেই পথের বর্ণনা তিনি লিখেছিলেন সেই সময়ের ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে ।  

ভুটানের দুই নদী 

আমি বেশ কয়েকবার ভুটানে গেছি । পারমিশনের জন্য যে নাকাল হতে হয় তারপর মনে হয় যেন না এলেই ভালো করতাম । একবার প্রবেশ করবার পর সমস্ত দৃশ্যপটই যেন পরিবর্তন হয়ে যায় । করোনা পরিস্থিতি অনেক পাল্টে গেছে । হয়তো কয়েক মাসের মধ্যেই ভুটানের প্রবেশ দ্বার খুলে দেয়া হবে । এবার আর বিনা পয়সায় পারমিশন নয় দিতে হবে ভিসা খরচ।


ভুটান কথা ও ডুয়ার্স 


ভুটানের কথা বলতে গিয়ে , বলেছিলাম : ভুটানের প্রবেশের জন্য অনেকগুলো দরজা আছে । কিন্তু দরজা গুলোর নাম আমি উল্লেখ করিনি ।  বলেছিলাম কিভাবে ভুটানে যাওয়া যায় আর কিভাবে বহু বছর আগে মানুষ গিয়েছিলেন । আজ একটু বিস্তারিত আলোচনা করব ভুটানের প্রবেশদ্বার নিয়ে এবং কিভাবে ভুটান ভারতের ছোট রাজ্যকে আক্রমণ করেছিল আর কিভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ভুটানে ঢুকে পড়েছিল । যদিও এর সাথে ভ্রমণের কোন সম্পর্ক নেই । তবে ভ্রমণ করতে গেলে ইতিহাস ভুগোল মাইথোলজি এগুলো একটু জানা দরকার । তাতে ভ্রমণ ভালো হয় আর জায়গাটা সম্পর্কে ধারণাটা পরিষ্কার হয় । বিভিন্ন বইপত্র ঘেটে যে সমস্ত তথ্য উঠে এসেছে সেগুলোই আপনাদের কাছে নিয়ে আসছি । একদিকে পশ্চিমবঙ্গ অন্যদিকে অসম এই দুই রাজ্যের একপাশে ভুটান । 

কেন ভুটান ? আর কেনই বা ভুটানের মানুষ বৌদ্ধ ধর্মকে নিজেদের বীজ মন্ত্র ভাববেন । বৌদ্ধধর্মের প্রচার আসলে প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রচার । নিম্নবর্গের মানুষদের উপর উচ্চবর্ণের মানুষদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ও শান্তির বাণী ব্যাপকভাবে প্রচার এর জন্য সবচেয়ে বেশি যে মানুষটির অবদান তাকে 'দ্বিতীয় বুদ্ধ'  বলা হত । তিনি আর কেউ নন তিনি পদ্মসম্ভবা । বৌদ্ধ ধর্মের  বজ্রশক্তি প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে ভুটানে এসেছিলেন নালন্দার মহাগুরু পদ্মসম্ভবা। 


তিনি প্রথম ভুটানকে বলেছিলেন দেবতাদের পদ্ম বাগান ।সেই সময় ছিল ভোটান্ত। ভোট অর্থে তিব্বত, অন্ত অর্থ প্রান্ত। অর্থাৎ তিব্বতের প্রান্তিক রাজ্য । অষ্টম শতাব্দীতে মহাগুরু সমাজের জনকল্যাণের জন্য মানুষকে বীজ মন্ত্র দিয়ে ফিরে এসেছিলেন দিওয়ান গিরি হয়ে । যেটি এখন অসম-ভুটান সীমান্তে।

আমরা যে ডুয়ার্সের কথা বলি । অর্থাৎ যে দুয়ারের কথা বলি । সেটা ভুটানের ঢোকার দরজা । ভুটানে প্রবেশের জন্য মোট দরজা ছিল ১৮ টি । এই দরজা গুলো পাহারার একজন অধ্যক্ষ ছিল তাকে বলা হত জংগুপেন। ১৮ টি দরজার মধ্যে উত্তরবঙ্গের  দিকে ছিল এগারোটি দরজা আর অসমের দিকে ছিল সাতটি দরজা। ভোট রাজ্য থেকে দুয়ারগুলি ছিল অনেক দৈর্ঘ্য রাস্তা । সেই রাস্তার যত গ্রাম  অরণ্য পর্বত নদী সবই ছিল  জংগুপেনের অধীনে । 

খয়ের বাড়ির জঙ্গলে

কি নাম ছিল সেই দরজার ? প্রথমে বলি উত্তরবঙ্গের । যে নামগুলো পাওয়া  ছিল ১৮৬৪ সালে ।ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল একটি মানচিত্র করেছিলেন ডুয়ার্স ও ভুটান কে নিয়ে । নামগুলি হলো : জামের কোট , চামুরচী ,লখিপুর (ভোমচি), বাল্লা ,মাদার , বাগাসা(বকসা) ভূল্লা ,গোমা , রেপু ,সিদলী , ছোট বিজ্নি । অসমের সাতটি দুয়ার ছিল বিজনী , চাপাগুড়ি , বক্সা , গুড়খুইয়া ,খালিং, বুড়ি গোমা, কুড়িয়া পাড়া। এই জায়গাগুলি পশ্চিমে তিস্তা নদী আর পূর্বে মানস নদীর ধার দিয়ে ।

এই জঙ্গলের মধ্যেও পরিকল্পিতভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি ঢুকে পড়েছিল । সেই সময় এই অঞ্চলগুলো ছিল একদিকে অরণ্য ও পাহাড়ে ঢাকা অন্যদিকে ম্যালেরিয়ার প্রভাব । তারমধ্যেও  হেস্টিং সাহেব ব্যবসা শুরু করলেন । ভুটান ছিল তখন তিব্বতের আশ্রিত একটি ছোট্ট অংশ । 


তখন ভুটানে ছিলেন দুই রাজা দেবরাজ আর ধর্মরাজ । ধর্মরাজ ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক এবং সন্ন্যাসী । এই দুই ভাই হঠাৎ করে কুচবিহারের রাজা ধৈর্যন্দ্র নারায়ণ ও সুরেন্দ্র নারায়ণকে বন্দী করে রাজ্য অধিকার নিতে শুরু করলেন । ভয় পেয়ে কুচবিহারের রাজপরিবার ইংরেজদের দ্বারস্থ হলেন । ইংরেজরা সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দুই ভাইকে উদ্ধার করলেন । এবং ভুটানের ওপর ঝাঁপিয়ে পরলেন । ভুটানের রাজারা ও ভাবলেন ইংরেজদের সাথে পেরে উঠবেন না । মধ্যস্থতার জন্য তদানীন্তন দালাইলামা কে সব জানালেন । দালাইলামা হেস্টিংসকে মধ্যস্থতার জন্য চিঠি লিখলেন । সালটা ছিলো ১৭৭৪। এই আঠারোটা দরজা দিয়ে ব্রিটিশ শুরু করে দিলো তাদের বাণিজ্য । আর আমরা শুরু করলাম ভ্রমণ ।আপাতত  ভুটান  যেতে না পারলেও ডুয়ার্স তো আমাদের জন্য খোলা আছে ।


মন্তব্যসমূহ

  1. এতখানি ইতিহাস জানা ছিল না, পড়লাম, জানলাম আর পড়তে পড়তে সেই সময়ে পৌছে গেছিলাম। অপূর্ব 🥰🥰

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভাল লিখেছেন অনেক ঐতিহাসিক তথ্য সংকলন করে।

    উত্তরমুছুন
  3. খুব সুন্দর লেখা। সুন্দর ভাবনা

    উত্তরমুছুন
  4. যথার্থই তোমরা ট্যুর করাও না ভ্রমণ করাও, এটা আবারও বোঝা গেল।

    উত্তরমুছুন
  5. Unknown কেন দেখাচ্ছে। ওপরের মন্তব্য আমি সৌরভ ভট্টাচর্য্যের

    উত্তরমুছুন
  6. অনেক কিছু জানতে পারলাম এটা থেকে। কোনোদিন সুযোগ হলে যেতে চাই।

    উত্তরমুছুন
  7. ঘরের কাছে এই বিদেশে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি ।কিন্তুআপনার লেখনীর মাধ্যমে না যাওয়ার আক্ষেপ অনেকটাই মিটলো ।

    উত্তরমুছুন
  8. ভালো লাগলো । অনেক কিছু জানতে পারলাম ।

    উত্তরমুছুন
  9. প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার সুন্দর বহিপ্রকাশ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম