বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়

 বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় 

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়  

গঙ্গার তীরে যদি শহর সে শহর তো সৌভাগ্যের শহর হবেই । মাটির একটা নিজস্ব গুণ থাকবেই । আমি পুজোর পর যে শহরে এসেছি তার নাম ভাগলপুর বিহারের একটি জেলা। ভাগলপুরকে বলা হয় সৌভাগ্যের শহর। সত্যিই আমার সৌভাগ্য যে আমি এই সৌভাগ্যের শহরে এসেচি । না এলে জানতেই পারতাম না এতো কিছু দেখার আছে । এক যাত্রায় দেখে নেওয়া যায় পাহাড়, জঙ্গল , নদী, ইতিহাস, মাইথলজি ।  মহাভারতের সময় গঙ্গার তীরে বুড়ানাথের প্রাচীন মন্দিরে পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাসের সময়ে এই মন্দিরে কিছু দিন অতিবাহিত করেছেন । ভাগলপুর জৈনদের পরম তীর্থ ক্ষেত্র । এই শহরে জন্ম গ্রহন করেন ১২ তম জৈন তীর্থঙ্কর বাসু পূজ। আমার চারদিন থাকার ভাবনা ভাগলপুরে । তারমধ্যে একদিন যাব প্রাচীন বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে । একদিন যাব মাইথলজির পথ ধরে মন্দার পর্বতে ।

বিক্রমশিলা খননকার্য পড়ে পাওয়া স্তুপ 

বিহার ছিল এক সময় সংস্কৃতি ও শিক্ষার মূল পীঠস্থান ।বুদ্ধদেবের ধর্মীয় অনুরাগীরা বা পৃষ্ঠপোষক শিক্ষার জন্য বেছে নিয়েছিলেন বিহারকে । প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় । বৌদ্ধ সংস্কৃতির পীঠস্থান । সেটা তৈরি হয়েছিল আজ থেকে ১৫০০ বছর আগে । তা ঠিক সাড়ে ৪৫০ বছর পরে বিহারে আরো একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলো । 

 নালন্দাতে শিক্ষার মান কমে গেছে এমন ধারণার থেকে রাজা ধর্মপাল (৭৮৩ থেকে ৮২০) বিক্রমশীলার প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মঠাধ্যক্ষদের মধ্যে প্রখ্যাত বৌদ্ধ ভীক্ষু শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর ।

বিক্রমশীলার নাম অমর হয়ে থাকবে বাঙ্গালী পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান(৯৮০)এর জন্য। তিনি এক সময় বিক্রমশীলার উপাচার্য(১০৩৪-৩৮)ও হন। তিব্বতী রাজার আমন্ত্রণে তিনি জীবনের শেষ ১৩ বছর তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম(বজ্রযান)এর নানা গ্রন্থ সংস্কৃত থেকে অনুবাদ, বিশ্লেষণ করেন, তিব্বতে আজও তিনি দ্বিতীয় বুদ্ধরূপে পুজিত হন। বিক্রমশীলার অন্য ছাত্রদের মধ্যে বিরোচন রক্ষিত(৭৫০), জেতারি, রত্নাকরশান্তি, জ্ঞানশ্রীমিত্র, রত্নবজ্র এবং বাগীশ্বরকীর্তি অন্যতম, তাঁরা প্রত্যেকেই জ্ঞানী দ্বারী রূপে সময় ব্যয় করেছেন তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিক্রমশীলায় একটি কেন্দ্রিয় বিপুলাকৃতি প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে লাগোয়া ছিল ছটি বিদ্যালয়। প্রত্যেক বিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য থাকত বিপুলাকৃতি দ্বার। প্রত্যেক দ্বারে ছিলেন দ্বারপণ্ডিত - তাঁদের সন্তুষ্ট করলে, বিদ্যালয়ে প্রবেশের ছাড়পত্র মিলত - অর্থাৎ ছাত্রদের বেছে বেছে নেওয়া হত - যারা অধিকারী তাঁরাই হতেন এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ছাত্র। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়াল 

আমরা যখন পৌঁছেছিলাম প্রায় বিকেল হয়ে গেছে । অতীশ দীপঙ্করের মত কোন দ্বার পন্ডিত  নেই । মিউজিয়াম কে বা দিকে রেখে মূল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উপস্থিত হলাম । এখানেই থাকতেন ৪ দ্বার পন্ডিত এখানে রক্ষী মানে পন্ডিত । তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই তবেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা যেত । খননকার্যের পর সেই  দ্বার গুলো আর দেখা যায় না । বিরাট জায়গা নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় । বিকেলও কানে আসছে না বৌদ্ধ মন্ত্র । বৌদ্ধ চৈতি । খননকার্যের মাধ্যমে পাওয়া যায় বিশাল একটি মঠ (৩৩০ মিটার বর্গাকার)। এর উত্তর গেটের আয়তাকার কাঠামোতে রয়েছে প্রায় ২০৮টি প্রকোষ্ঠ। এছাড়া এর বাইরের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে আয়তাকার ও বৃত্তাকার কিছু অবয়ব। প্রতিটি প্রকোষ্ঠে ছিল ১.৩৫ মিটার প্রশস্ত প্রবেশদ্বার। প্রকোষ্ঠগুলিতে ছিল গড়ে ৩ মিটার এবং ২ মিটার আকারের বেদি সদৃশ শয্যাস্থল। প্রকোষ্ঠগুলি থেকে ৩.১০ মিটার চওড়া একটি বারান্দায় যাওয়া যেত। বারান্দাটি উত্তরদিকে ৩০ মিটার এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ৪০ মিটার লম্বা। বুদ্ধের জীবন কাহিনী এখনো ফিরে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে দেওয়ালে । এখানেই ছিল প্রাকৃতিক উপায় কি করে ঘরকে শীতল রাখা যায় । মানে এয়ারকন্ডিশন রুম । সন্ন্যাসীদের বসবাসের জন্য বুদ্ধদেব পাঁচ ধরনের বাসস্থান নির্দেশ করেছিলেন বলে জানা যায়। বিহার ছিল এগুলির মধ্যে একটি। বিহারগুলি ধীরে ধীরে বেশ বড়সড় আবাসস্থলে পরিণত হয় এবং সন্ন্যাসীরা সেখানে সম্মিলিতভাবে জীবনযাপন করতেন।

খননকার্যের পর পাওয়া ধ্বংসাবশেষ 

কিভাবে কি এত বড় বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তার কোনো ইতিহাস নিয়ে নানা মত আছে  । তবে শোনা যায় বা প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলেন খননকার্যের সময় প্রচুর কাল ছাই পাওয়া যায় সেই থেকেই অনুমান করা হয়  বিরাট অগ্নিকাণ্ডের ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হয়ে যায় । আবার ভিন্ন মতে বক্তিয়ার খিলজি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয় । খুব অবাক লাগে এতো বড় একটা বৌদ্ধ সংস্কৃতি এখানে রয়েছে  তা অনেকই জানেন না। সরকারি ভাবেও তেমন প্রচার নেই। ভারত সরকারের  পর্যটন বিভাগের কাছে আমার অনুরোধ বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়কে বৌদ্ধ সার্কিট এর সাথে যুক্ত করে দেয়া হোক ।


খনন করে পাওয়া মূর্তি 

 হাতে সময় থাকলে একদিন ভাগলপুর থেকে চলে যান মন্দার পর্বতে। এই মন্দার পর্বত কে সমুদ্র মন্থন করবার সময় মন্থন দন্ড করা হয়েছিল । 

কী ভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ভাগলপুর গামী ট্রেনে চেপে   ভাগলপুরের আগের স্টেশন পহেলগাঁও নামুন । সেখান থেকে অটোতে বা গাড়িতে চলে আসুন। সব থেকে ভালো হয় ভাগলপুর  থেকে গাড়ি নিয়ে দেখে ফিরে আসা।বিক্রমশীলার (গ্রাম: আন্তিচক, জেলা ভাগলপুর, বিহার) ভাগলপুর শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।  ভাগলপুর-সাহেবগঞ্জ সেকশনের কাহলগাও স্টেশন থেকে ১৩ কিলোমিটার । কহেলগাঁও থেকে ২ কিলোমিটার অনাদিপুর গ্রাম। এই গ্রামের পাশেই বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসাবশেষ রয়েছে । 

আমরা গিয়েছিলাম ভাগলপুর থেকে । খুব খারাপ রাস্তা । যার জন্য ভাগলপুর থেকে ট্রেনে করে কহেলগাঁও স্টেশনে নেমে অটো বা কারে যাওয়াই ভালো । যদি ট্রেন চলে তবে তখন ভাগলপুর থেকে ট্রেনে করে কহেলগাঁও যাওয়াই ভালো । কেননা ভাগলপুর থেকে বিক্রমশিলা যাওয়ার পথটা অসম্ভব খারাপ । বিক্রমশীলার সংগ্রহশালার   ভারতীয়দের জন্য কুড়ি টাকা টিকিট ।  

কোথায় থাকবেন : বিক্রমশীলার আশেপাশে কোন হোটেল নেই । আপনাকে চলে আসতে হবে ভাগলপুর। দূরত্ব ৫০ কিমি। ভাগলপুর শহরে।নানা মাপের হোটেল আছে। 

মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভালো লাগলো, বেশ কিছু অজানা তথ্য জানতে পারলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. দারুন, অনেক অজানা তথ্য জানলাম l এতো ইতিহাস ছড়িয়ে আছে অথচ কোনো প্রচারই নেই l

    উত্তরমুছুন
  3. বামাদার সাথে বিক্রমশীলা মহাবিহার দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।তাই লেখাটাও আমার কাছে প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে....

    উত্তরমুছুন
  4. ইতিহাস অনেক কথা বলে যা মনের মধ্যে গেথে থাকে আজীবন। সুন্দর ভাবনার সুন্দরতম বর্ননা।

    উত্তরমুছুন
  5. ইতিহাস যে কত কিছুকে মনে করিয়ে দেয় তার সব চেয়ে বড় উদাহরণ এই লেখাটা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

ইতালির কলোসিয়াম

রুদ্রপ্রয়াগ