পুরুলিয়ায় দু'দিনের ভ্রমণ
অচেনা পুরুলিয়ায় দু'দিনের ভ্রমণ
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়।
একেই বলে রুচির সমগ্রতা ।একজন এসে আমায় বললেন পুরুলিয়া যাচ্ছেন ? আমি বললাম হ্যা । তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন পুরুলিয়ার? আমি কিছু বলার আগেই তিনি বললেন পাখি পাহাড়,মুরগুমা ,আপার ড্যাম ,লোয়ার ড্যাম , সব দেখে আসবেন, খুব ভালো লাগবে । আমি আর কিছু বলতে পারলাম না । তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম । আমি যাচ্ছি নিস্তব্ধতার তরঙ্গে । কি করে তোকে বোঝাই আমি কিছুই দেখতে যাচ্ছি না । আমি যাচ্ছি নিজের সাথে কথা বলতে ।
পুরুলিয়ার সুন্দরবন |
আকাশ জুড়ে আঁকাবাঁকা রঙিন আলোর রেখা ।আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসছে । একটু আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়েছে রঘুনাথপুরে । জয়চন্ডী পাহাড় পেরিয়ে লেভেল ক্রসিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছি । আরেকটু গেলেই আদ্রা রেলওয়ে স্টেশন । সেখান থেকে যেতে হবে আমাদের কাশীপুরে । কাশিপুর রাজবাড়ি সকলের খুব পরিচিত জায়গা । এখান থেকে আরও ৭ কিলোমিটার যেতে হবে আমাদের । দ্বারকেশ্বর নদীর ব্রিজ পেরিয়ে যখন যাচ্ছি অন্ধকার নেমে এসেছে,কিন্তু কাশ ফুলের সাদা দোলা দেখা যাচ্ছে । আমরা যাচ্ছি রঞ্জনডি লেকে। যখন পৌঁছলাম ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা বেজে গেছে । লেকের ধারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা । দেখে মনে হলো এতো কাশ্মীরের ডাল লেকের ধারে আছি ! হাউস বোট নেই, কিন্তু ডিঙি নৌকা আছে । আজ রাতে লেকে মাছ ধরা হবে তার প্রস্তুতি চলছে । জ্যোৎস্নার আলো নেই । আকাশ জুড়ে মেঘ আর মেঘ । কি করে দেখবো ? অন্ধকার স্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে টর্চের আলো চিনিয়ে দিচ্ছে আমরা জলের পাশেই আছি ।
রঞ্জন ডিহি |
সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন। মাছ ধরা শেষ । মাছ চলে গেছে কাশীপুরের বাজারে। বিশাল লেকের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে নানা ধরনের পাখি।কয়েকটা বকও আছে তার মধ্যে । রোদ ঝলমল করছে আকাশ জুড়ে । তারমধ্যে সাদা সাদা মেঘের পাহাড় । নীল আকাশের মাঝে এরকম মেঘ দেখলে মনে হয় পাহাড়ের মাথায় জমে আছে বরফের আস্তরণ । এসেছি রঞ্জন ডিহির যোগমায়া সরবরাহে । বহু বছর পরে আমার মনে হল হ্যাঁ এখানে বসেই নিজের সাথে অনেক গল্প করা যায় । নিঃশব্দের তর্জনী যদি উপর দিকে তুলে দিই তাহলে হয়তো স্তব্ধতা' ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। জায়গাটা কি তার সাথে তুলনা করা যায় ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না , সরোবরে শুরুটা আমি দেখতে পাচ্ছি শেষ আর দেখতে পাচ্ছিনা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা ভাবে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে । লুকিয়ে পরেছে জঙ্গলের ভেতর । কখনো ভাবি সুন্দরবনের এরকম খাড়ী দেখেছিলাম অনেক । আবার যখন দেখি জলের মধ্যে শুকনো গাছ দাঁড়িয়ে আছে তখন মনে হয় পেরিয়ার লেকে আছি। আমার বন্ধু প্রভাত বল্ল ছবিতে কাশ্মীরের ডাল লেককে এরকম লাগে। কারুর সাথে কারোর তুলনা হয়না! প্রত্যেকের একটা নিজস্ব চরিত্র আছে নিজস্ব রূপ আছে । আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে এই সরোবর পুরুলিয়ার নিজস্ব চরিত্র কে ধরে রেখেছে । দিঘী ভরা জল করে টলমল । সরোবরের ধারে বসে থাকার জন্য স্টেডিয়ামের মত বসার জায়গা । চারিপাশে জঙ্গল । জঙ্গলের একপাশে বসে থাকার জন্য সুন্দর সুন্দর সিমেন্টের চিয়ার করে রাখা । এখানে বসে থাকলেই সময় কেটে যায়। ইচ্ছে হলে ডিঙি নৌকা নিয়ে শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত হওয়া যায় ।
দ্বারকেশ্বর নদী |
অলস দুপুরে যখন নিচু ভ্যালুমে রেডিও বাজে । পায়রারা খোপে বসে বক বকম করে তখন যোগমায়া সরবরাহে জল উঁচু নিচু করে ঢেউ তোলে । নিজেকেই বললাম হ্যাঁ রে তুই কী বিবাগী হবি? কেন তোর এই স্তব্ধ দুপুরে বসে থাকা ?
দুপুরে খাবার পর একটু ঘুম পায় । আজও পেয়েছিল । চোখ বুজে একটু শুয়ে ছিলাম । বাইরে তাকিয়ে দেখি সরবরাহের জল কেমন যেন লালছে লালাছে লাগছে । বুঝতে পারিনি বিকেল গড়িয়ে গেছে, জঙ্গলের ভেতর থেকে দিনের আলো ফুরিয়ে আসছে । যোগমায়া রিসোর্টের ছাদে চলে যাই । বৃষ্টি ভেজা সবুজ পাতার ভেতর লাল সিঁদুরে আভা চকচক করে । ভরা যৌবনের মত টলমল করছে জল , গাছের মাথায় লুকিয়ে পড়ছে সূর্য । এ যেন এক ব্রাহ্মমুহূর্ত । কি করে বর্ণনা করি , কি রঙ দিয়ে যে এই ছবি আঁকবো নিজেও জানি না ! কাল সকালে ফুটিয়ারি ড্যাম দেখতে যাব। আমার যাবার কোন ইচ্ছে নেই এখান থেকে। তবুও যেতে হবে। আরেকটা সকাল আমার চোখে দেখবো সেই আনন্দ নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যাই।
রিসোর্ট |
গাড়িটা যখন রঞ্জনডিহির মোড় থেকে বা দিকে ঘুরে গেল আমার চোখও চলে গেল সবুজ প্রান্তরে । অসংখ্য কাশফুলের ঢেউ তরঙ্গের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে । দ্বারকেশ্বর নদীর ব্রিজে গাড়িটাকে থামাতে বলি । অলস নদীকে কেউ যেন পিছন থেকে ঠেলে দিচ্ছে। তার বয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তবুও স্রোতের শব্দ ! বড় বড় পাথর গুলো মনে হচ্ছে তাকে বিশ্রাম করার জায়গা দিচ্ছে । আর কাশফুলের দোলা তাকে বাতাস দিচ্ছে । আমিও যেন তাকে খোজার জন্য হুড়মুড় করে নেমে যাই নদী তীরে। ভ্রমণে একটা নদী না থাকলে কেমন লাগে। তাকে পেলে বাড়ি যাব এই ভাবনা সব সময় থাকে ।এই মৈত্রীর বন্ধন যেন আমায় ছেড়ে না যায়। আবার তার সাথে দেখা হলো কাশীপুর ছেড়ে যাবার পরই । সেই দ্বারকেশ্বর নদীর ব্রিজ পেরিয়ে চললাম। আকাশে মেঘেদের বিচরণ একটু ভয় ভয় লাগে। তালগাছ কেন যে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে তার মানেও বুঝতে অসুবিধা হয় না । বড় নিস্তরঙ্গ এই দাঁড়িয়ে থাকা। জন প্রাণী নেই, দুপুরও এখানে একা বিচরণ করছে। কাল খুব বৃষ্টি হয়েছে ,মাটি থেকে একটা ভিজে ভিজে গন্ধ বের হচ্ছে তার মধ্যে আমাদের গাড়ি এসে থামলো তাল গাছ তলায়। তালের গন্ধ মম করছে। কী কপাল একটা তাল এসে পড়ল আমাদের সামনে। আমি তালের লোক নই। তাল তলায় গিয়ে দেখলাম অনেক তাল । এখানে চল তাল কুড়তে যাই বলার লোক নেই। চারিপাশে তাল গাছ, খেজুর গাছ। এই ভারদো মাসে রুক্ষ জমিতে সবুজের ভালবাসা চোখের আরাম দেয়।
ফুটিয়ারি ড্যামে |
ফুটিরিয়া ড্যাম যেন ফরেস্ট পুল আই। দূর থেকে সেই রকমই মনে হয়েছিল। সামনে গিয়ে যখন দেখলাম তখন অবাক করার মতো। জলের ভেতরে পাহাড়ের ছায়া এসে পরছে। এপার ওপার দেখা যাচ্ছে না এতো বিশাল। চারিপাশে গড়ে উঠেছে সুন্দর সুন্দর রিসর্ট । এরকম সুন্দর পরিবেশে খুব সুন্দর মানিয়েছে এই থাকার জায়গা গুলো।একটা পাহাড় একাই দাঁড়িয়ে এই ফুটিয়ারি ড্যামের
রূপকেই পাল্টে দিয়েছে। লেকে নৌকা নিয়ে মনের আনন্দে ঘোরা যায়। লেকের পাড়ে সুন্দর বসার জায়গা। পিকনিক করার আদর্শ পরিবেশ করে রাখা হয়েছে। একজন নৌকাচালক এসে বল্ল ওই পাহাড়ের নিচে যাবেন? ওখানে যান খুব সুন্দর লাগবে । ওখানেই দ্বারকেশ্বর নদীর উৎস। পাহাড়পুর যেতে পারেন। ভাবি কত কিছু দেখা হয়নি। এই জীবনে আর দেখা মনে হয় হবে না। এই আমির আবরণের রূপ চর্চা করতে করতেই শেষ হয়ে গেলাম। ফিরতে হবে সে অপেক্ষা করছে। সে মানে সেই যোগমায়া । সেই রঞ্জনডিহি। যেখানে রেখে এসেছি আমার স্বপ্নকে।
ফুটিয়ারি |
কী ভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে ট্রেনে আদ্রা। সেখান থেকে বাসে কাশীপুর। সেখান থেকে আটোতে চলে যান রঞ্জন ডিহি॥ কলকাতা থেকে বাসে বলরামপুর এসে বাসে করেই কাশীপুর।
কোথায় থাকবেন : রঞ্জন ডিহিতে একমাত্র থাকার জায়গা যোগমায়া রিসোর্ট । ফুটিয়ারিতে নতুন কয়েকটা সুন্দর রিসোর্ট আছে ।
সবাই মন্তব্য করুন এখানে লিখুন ।
উত্তরমুছুনমুগ্ধ হলাম❤❤😯
মুছুনNice verynice
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনদারুণ লিখেছেন । খুব সুন্দর
উত্তরমুছুনঅনেকে অনেক ধন্যবাদ
মুছুনআপনার নজরে পুরুলিয়া যেন এক নতুন রুপ নিয়েছে।কি সুন্দর ভাবে বর্নণা করেন আপনি,যেন মনে হয় আমি চাক্ষুষ দেখছি সবকিছু। আপনার সুনিপুণ দৃষ্টিভঙ্গি পুরুলিয়ার ঐতিহ্যকে আরও বেশি সমৃদ্ধশালী করেছে। পুরুলিয়ার রুপ ও সন্দর্যের সঠিক বর্নণা আপনি আপনার লেখায় তুলে ধরেছেন। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে 😊
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনApurbo
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ।শারদ শুভেচ্ছা জানবেন
মুছুনBhalo
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকে
মুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনKhub sundor hoyeche. Pore khub valo laglo
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা নেবেন।
মুছুনএকমাত্র আপনার মতো দক্ষ ভ্রমণার্থীই পারেন ,পুরুলিয়ার সম্পূর্ণ সৌন্দর্যকে আবিস্কার করতে ও তার সঠিক বিশ্লেষন করতে।
উত্তরমুছুনমুগ্ধ হলাম l আপনার চোখ আছে বটে প্রকৃতিকে দেখার l
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা নেবেন
মুছুনমন পানসিতে ভাসলাম আপনার লেখার ধারাপথে ।
উত্তরমুছুন'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ ' শুনতে পাচ্ছি।
ভালো থাকবেন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা ॥
মুছুনআবার পড়লাম। খুব খুব সুন্দর ।
উত্তরমুছুনdhnyb
মুছুনVery nice
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনKhub sunder lekh
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন