লায়ন সিটি : সিঙ্গাপুর

 লায়ন সিটি : সিঙ্গাপুর

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়

সিঙ্গাপুর নামটা শুনলেই আমার মনটা ভয়ে গুটিয়ে যায় । আবার আনন্দ ও হয় । প্রথমবার সিঙ্গাপুরে গিয়ে আমার এক পিসিকে সিঙ্গাপুর বিমান বন্দরে হারিয়ে ফেলেছিলাম । ৮ ঘন্টা এয়ারপোর্টে বসে থাকার পর , তাকে খুঁজে পাওয়া গেল , আমাদেরই বুক করা হোটেলে গিয়ে । তিনি এয়ারপোর্টে  পথ হারিয়ে কাউকে না জানিয়ে একাই চলে গিয়ে ছিলেন হোটেলে । সে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ৮ ঘন্টা আমার সময় কেটেছে । সুখের কথা আবার পরের বার আমার হারিয়ে যাওয়া থাইল্যান্ডের বান্ধবী জুলিকে খুঁজে পেয়েছিলাম এই সিঙ্গাপুরের বাসস্ট্যান্ডে । সেও এক পরম প্রাপ্তি । 

সিঙ্গাপুরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান 


ছোট্ট একটা দেশ সিঙ্গাপুর । অসম্ভব সময়ানুবর্তিতা । সুশৃংখল একটি দেশ সারা বিশ্বের মধ্যে এই দেশটাই মনে হয় সবচেয়ে বেশি প্রফেশনাল। কঠিন ইংরেজি বলে । লন্ডনে গিয়ে দেখেছি ব্রিটিশরা ও এত শক্ত ইংরেজি বলে না । সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গিয়ে সময় নিয়ে বাঙালির যে কি লেজে গোবরে অবস্থা হয় তার প্রমান আমি অনেকবার পেয়েছি । গাড়ি যদি সকাল সাত টায় রওনা হয় , হোটেলে সে গাড়ি চলে আসে সাড়ে ছয়টা থেকে পৌনে সাতটার মধ্যে । আপনি যদি সাতটার মধ্যে গাড়িতে বসতে না পারেন তাহলে গাড়ি আপনাকে ফেলে চলে যাবে । আপনার ভ্রমণ বাতিল অথবা নিজের পয়সায় ট্যাক্সি করে সেই জায়গায় পৌঁছতে হবে । 

 সিঙ্গাপুর নিয়ে দু একটা তথ্য জানাই : সিঙ্গাপুরের এক হাজার ডলারের নোটের পিছনে দেশের জাতীয় সঙ্গীত লেখা থাকে। সিঙ্গাপুরের জাতীয় সঙ্গীত হল মালয় ভাষায়, 'মাজুলা সিঙ্গাপুর' বা সিঙ্গাপুর এগিয়ে চলো। সিঙ্গাপুরে চারটি সরকারি ভাষা রয়েছে। ইংরেজি, মান্দারিন, মালয়ের সঙ্গে রয়েছে তামিল ভাষাও। সিঙ্গাপুরকে বলা হয় সিংহের শহর বা লায়ন সিটি। অথচ বাস্তবে গোটা সিঙ্গাপুরে একটাও সিংহ নেই। সিঙ্গাপুরের ডাক নাম ফাইন সিটি বা জরিমানার শহর। কারণ বিভিন্ন ছোট ছোট কারণে এখানে জরিমানার ব্যবস্থা আছে।সিঙ্গাপুরের চিড়িয়াখানায় কোনও খাঁচা নেই। পশুপাখিদের কার্যত উন্মুক্ত রাখা হয়। রাতে চিড়িয়াখানা খোলা থাকে, নাইট সাফারির ব্যবস্থা আছে। সিঙ্গাপুর নিয়ে অনেক তথ্য আমার কাছে আছে । সব লেখার দরকার নেই । 


  প্রথম দিনই আমি নাইট সাফারি করেছিলাম সেটা নিয়ে দু-একটা কথা বলা শুরু করি । প্রথমেই বলেছি  সিঙ্গাপুরের সমস্ত পশুপাখি উন্মুক্ত থাকে । ছোট্ট একটা ট্রয় ট্রেন নিয়ে গিয়ে আমাদের বসিয়ে দেয়া হল নাইট সাফারির জন্য । আলো অন্ধকার করে রাখা হয়েছে জায়গাগুলোকে । তার মধ্যেই জীবজন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে । এটা বাচ্চাদের জন্য খুবই ভালো । কিন্তু আমার মত পাগল মস্তিষ্কের মানুষের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক । সকালবেলা সড়ক পথে  মালয়েশিয়া থেকে দুবার চেকিং এর পর বিকেলে এসেছিলাম সিঙ্গাপুরে । কিছুটা বিশ্রাম নিয়েই যদি এইরকম নাইট সাফারি করতে  হয় সেটা বড় কষ্টের । 

সিঙ্গাপুর ভ্রমণকারী পর্যটকদের জন্য অন্যতম আর্কষনীয় স্থান সেন্টোসা আইল্যান্ড। অসম্ভব সুন্দর পর্যটন এলাকা সেন্টোসা। সিংহের মুখ থেকে জল বের হচ্ছে আর পর্যটকরা নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলছেন । ছোট বড় মিলিয়ে বেশ কয়েকটি সিংহের মুখ রয়েছে ।  আঁকাবাঁকা সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে পরিষ্কার নীল জলের দিকে তাকালে প্রাণ জুড়িয়ে যায়। সৈকতের এক বাঁকে আছে পাথর বাঁধানো, পাশেই ডাল ছড়িয়ে আছে বড় বড় নানান গাছ; সমুদ্র সামনে নিয়ে গাছের শীতল ছায়ায় পাথরে বসে ঝিরিঝিরি বাতাস গায়ে মেখে হাতে থাকা কিছুটা সময় সুখেই কাটিয়ে দেওয়া যায় সেখানে। একাদিক বিচ, ছোট ছোট উপদ্বীপ, ফাইভ স্টার হোটেল, রিসোর্ট ওয়াল্ড, থিমপার্ক, শপিং মল, ফোটকোর্ট, বিভিন্ন প্রকারের রেস্টুরেন্ট, ইউনির্ভাসেল স্টুডিও, পিকনিক স্পটসহ বিনোদনের বহু ব্যবস্থা আছে সেন্টোসায়। টানা কয়েকটা দিন সেন্তোসায় কাটিয়ে দিলেও আরো থাকতে মন চাইবে । 

গার্ডেন থেকে তোলা 

খুব ছোট্ট একটা দেশ খেলার মাঠের অভাব বলে সমুদ্রের উপর খেলার মাঠ বনিয়েচে আবার স্টেডিয়াম বানিয়েচে ।সেটাও দেখার মতো ।

সিঙ্গাপুরে  ভ্রমণে গেলে যে জায়গায় বাদ দেয়া চলবে না সেটা হল- গার্ডেন বাই দ্যা বে। এটি একটি অত্যাধুনিক সু সজ্জিত বোটানিক্যাল গার্ডেন। এই বাগানে সন্ধ্যায় গেলে সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হবেন। কারণ এখানে রয়েছে সুপারট্রি নামের বিশাল বিশাল কাঠামো। যার শরীর বেয়ে উঠে গেছে নানা জাতের লতানো গাছ ও নানা রঙের আলোকসজ্জা। এই সুপারট্রি গুলোতে বেয়ে উঠেছে প্রায় ২০০ জাতের লতা গাছ। এই বাগানেই আয়োজিত হয় গার্ডেন র‍্যাপসডি নামের প্রদর্শনী। আমরা যাকে বলি লাইট এন্ড সাউন্ড । সুপারট্রি গুলোর পাদদেশে নানা রকম আলোর খেলা ও শব্দ বিন্যাসে সাজানো এই গার্ডেন র‍্যাপসডি শো। গাছের মধ্যে এরকম আলোর খেলা পৃথিবীতে আর কোথাও হয় কিনা আমার জানা নেই । 

গার্ডেন বাই দ্যা বে এর আরেকটি আকর্ষণ হল ক্লাউড ফরেস্ট ডোম। দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকা এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সত্যিকারের ক্লাউড ফরেস্টের আবহাওয়াকে কৃত্তিম ভাবে তৈরি করা হয় এই গার্ডেনের ভিতরেই। দুটি তলায় ভাগ করা আছে । উপর তলার এক পাশে এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ৩৫ মিটার দীর্ঘ কৃত্তিম জলপ্রপাত। এখানে দেখতে পাবেন চোখ জুড়ানো সুন্দর নানা ধরনের পরগাছা যেগুলো প্রাকৃতিক ভাবে শুধুমাত্র ক্লাউড ফরেস্টেই জন্মায়। রাতের বেলা লাইট অ্যান্ড সাউন্ড দেখেছিলাম । সে এক বিস্ময়কর অনুভূতি । এক কথায় অসাধারণ । 

গার্ডেন বাই দ্যা বে তে রয়েছে ফ্লাওয়ার ডোম নামের বিশ্বের সব চেয়ে বড় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গ্রিন হাউজ। এটি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রকৃতিকে হুবাহু তৈরি করে এই কাঁচের তৈরি ঘরের ভেতর। যেখানে কৃত্তিম ভাবে বেড়ে উঠছে ১৬০ প্রজাতির প্রায় ৩২,০০০ গাছ। 

মেরিনা উপসাগরে লেজার শো দেখার মতো। উপসাগরের উপরে দুর্দান্ত স্পেকট্রা লেজার শোয়ে দেখার জন্য গ্যালারি বানিয়ে রাখা হয়েছে ।   ছবিগুলি জলের উপর প্রক্ষিপ্ত, উপসাগরের উপরে সঙ্গীত বাজছে - সবকিছু অবিশ্বাস্যভাবে দর্শনীয় দেখায়। এটা অবশ্যই দেখা উচিত ।

এই হোটেলে আমরা ছিলাম 
সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ার লন্ডনের 'লন্ডন আইয়ের' মত, তবে উচ্চতায় মনে হয় লন্ডন আইয়ের চেয়েও কিছুটা বেশি।লন্ডন  আই থেকে টেমস নদীকে অসাধারণ লাগে তেমনি সিঙ্গাপুর থেকে সমস্ত শহরটাকে একবার দেখে নিয়ে যায় ।   একেবারে বিশালাকার যাকে বলে।  যেদিকেই যাই না কেন ফ্লাইয়ারটা চোখে পড়বে । একদম মাথার ওপরে যখন ফ্লাইয়ারে ক্যাপশনটা ওঠে একদিকে মালয়েশিয়া অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া কে দেখা যায় । আমি দুবার এই ফ্লাইয়ারে চেপেচি , একবার সকালে একবার রাতে । ফ্লাইয়ারের রাইডে চেপে আমাদের ক্যাপসুলটা যখন একদম উপরে উঠেছিলো তখন চারিদিকে তাকিয়ে রাতের সিঙ্গাপুরকে অলৌকিক একটা জায়গা মনে হয়েছিলো। নানা রঙের আলোয় ঝলমলে সিঙ্গাপুরের রাতের রূপ দেখে বর্তমান দুনিয়ার পর্যটকদের জন্য সিঙ্গাপুর কেন এত আকর্ষনীয় একটা জায়গা সেটার কারণ বেশ বুঝতে পারা যায়। সিঙ্গাপুর ফ্লাইয়ারের উপর থেকে সেবার আমরা অনেক কিছুই দেখেছিলাম। পৃথিবীর অন্যতম বিশ্বয়কর হোটেল মেরিনা বে স্যান্ডস , যেটা পাশাপাশি তিনটি ৬০ তোলা বিল্ডিয়ের উপরে একটা জাহাজাকৃতির সমতল ছাদ দিয়ে সংযুক্ত, সেই হোটেল বিল্ডিংটি ফ্লাইয়ারের একদম কাছে থাকায় সেটা খুব ভালো করে দেখা যায় । 

পরের দিন সকালবেলা গিয়েছিলাম ইউনিভার্সাল স্টুডিও তে । ইউনিভার্সাল স্টুডিও সিঙ্গাপুর’ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ২০১১ সালের ২৮ মে। ১২০ একরের রিসোর্ট ওয়ার্ল্ড সেন্টোসার ৪৯ একরের বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত এ স্টুডিওতে সব মিলিয়ে রাইড রয়েছে ২০টি।  প্রবেশমুখেই রয়েছে ইউনিভার্সাল স্টুডিওর সেই বিখ্যাত লোগো। ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর চারপাশে ‘ইউনিভার্সাল’ লেখা। বিশাল গেটের ওপরে লেখা ‘ইউনিভার্সাল স্টুডিও সিঙ্গাপুর’।সাতটি থিম জোনে ভাগ করা পুরো স্টুডিও। এগুলো হলো হলিউড, নিউইয়র্ক, সাই-ফাই সিটি, অ্যানশিয়েন্ট ইজিপ্ট, দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড, ফার ফার অ্যাওয়ে ও মাদাগাস্কার। এর মধ্যে প্রবেশ পথ পার হয়েই পাওয়া গেল হলিউড ‘ওয়াক অব ফেম’। আমি দু-একটা রাইড করেছিলাম । তবে এক কথায় অসাধারণ । দেখতে দেখতে সকাল দশটা থেকে কখন যে বিকেল পাঁচটা হয়ে গেল বুঝতে পারিনি ।

কেনা কাটা নিয়ে বিশ্ব জুড়ে সিঙ্গাপুরের একটা নাম আছে । এমন কি চীনারাও সমান্য বাজার দোকান করতে ছুটে আসেন এই দেশে । ভরসা একটাই কোন নকল জিনিষ এ দেশে বিক্রি হয় না । এমন কি সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস কখনো পুরনো বিমান আকাশে ওড়ায় না । আমাদের দৌড় মানে বাঙ্গালীদের দৌড় মুস্তাফি মার্কেট । একদিকে অসংখ্য বাংলাদেশী বাংলা ভাষায় কথা বলছেন , অন্যদিকে তামিলরা পসরা সাজিয়ে বসে আছেন । কেনাকাটায় আমার তেমন ঝোঁক নেই । মুস্তাফি মার্কেটে বাংলায় কথা বলতে বলতে মনে হল যেন ঢাকায় আছি । সেখানে থেকে গেলাম চায়না মার্কেটে । ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটা বেজে গেছে । হোটেলে ফেরার জন্য খনন করে হাঁটতে থাকি ।

কিভাবে যাবেন ? সারা বিশ্বের সাথে বিমানে সিঙ্গাপুরের যোগাযোগ রয়েছে । যদি কেউ মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরে আসতে চান তাহলে বাসে আসতে পারেন । মালয়েশিয়া থেকে সরাসরি বাস আসছে সিঙ্গাপুরে । ছোট্ট দেশ কিন্তু হোটেল সংখ্যা অনেক বেশি । নানা মাপের হোটেল আছে । খাওয়ার জন্য প্রচুর বাঙালি হোটেল রয়েছে সিঙ্গাপুরে । 

মন্তব্যসমূহ

  1. সব ঠিক জলজ্যান্ত বর্ণনা,কিন্তু,সিঙ্গাপুর এর পৃথিবীখ্যাত শপিং মল " MUSTAFA MARKET," একটু পরিবর্তন করলে ভালো হয়।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনার লেখা পড়ে জানতে পারলাম সিঙ্গাপুর এ অনেককিছু এ্যাডিশন হয়েছে কারন সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম ২০০৯ সালে। আপনার লেখা টা পড়ে এখন আরেকবার যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে।চলুন প্রোগ্ৰাম বানান বামাদা।
    ডাঃ অচিন্ত্য কুমার পোদ্দার।
    ভিলাই।

    উত্তরমুছুন
  3. Ato sundor bornona.... Manosvromon hoye gelo Bamada... Aapni khb vlo thakun...

    উত্তরমুছুন
  4. Dada khub valo laglo...

    Ami 1 bar gea6e ...
    Apnr lekha pora sob ki6u chokher samne vasoman holo

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম