পিসার হেলানো মিনার

পিসার হেলানো মিনার  

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় ।  

যাচ্ছি পিসা । আমার এক সহযাত্রী বলবেন পিজা যাচ্ছি ? ভদ্রলোকের পদ্মাসমভূমি অঞ্চলের শিকড় ছিলো । এই কথা  শুনে আরো এক ভদ্রমহিলা বল্লেন , বামাপদ দা  পিজা খাওয়াবেন তো? আরে কেন খাবেন না , ইটালি এসেছেন পিজা তো খাবেন ? সারা বাস জুড়ে হাসাহাসির মাঝে বাস  দাঁড়িয়ে পড়লো । বললাম এসে গেছি । এখান থেকে লোকাল বাসে আমাদের যেতে হবে । পাঁচ মিনিটের  বাস পথ । এই পথে যাবার আগে সবাইকে বলে দিলাম পকেট, পাসপোর্ট  সাবধান । আর সাবধান এখানকার কালোমানুষ গুলোকে। এদের কাছে কোন কিছুর দর করবেন না । এরা পেটের দায়ে নাইজেরিয়া,  আফ্রিকার কোন দেশ থেকে এসেছেন। মূলত এরা ছাতা, ব্যাগ , বিভিন্ন ধরণের খেলনা বিক্রি করেন । মুশকিল হচ্ছে ভাষা । আর ইন্ডিয়ান মানুষদের কাছে এরা বিক্রি করতে চায় না । কেননা ইন্ডিয়ান মানুষ বড্ড বেশি বার্গেনিং করে । রেগে যায় সেখান থেকেই যত  বিপত্তি । 


পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের ভেতরে ছিলো পিসার লিনিং টাওয়ারের । ছোট বেলায় পড়া । কত মুখস্ত করেছি । কত ছবি  সেটা  দেখার একটা অন্য রকম অনুভূতি । প্রথমবার যখন আসি  বুকের ভেতরে একটা পেন্ডুলাম দুলছিল। দোলার কারণ ছিল । ভিনসেনজিও ভিভিয়ানি একটা লেখা পড়েছিলাম গ্যালিলিওকে নিয়ে । তিনি ছিলেন গ্যালিলিওর শিষ্য। আবার ছোট বেলায় চলে যাচ্ছি , কেন যাব না বলুন , সেকি ফের আসে ? এলো পিসায় এসে । বিজ্ঞান বইতে পড়া ।  সেখানে  গ্যালিলিওর দোলন সংক্রান্ত কিছু সূত্র ছিল। ‘বায়ুশূন্য অবস্থান থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভরের পড়ন্ত বস্তুর গতিবেগ সমান’।  (মনে পড়েছে?  পড়বেনা মনে ?  সেকি হয় যেটা আমি প্রতিবার ভুল বলতাম আর ফিজিক্সের টিচার অরুণবাবুর কাছে বকুনি খেয়ে বসে পরতাম ।) ধারণা করা হয় যে, বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী গ্যালিলিও তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের জন্য পিসার হেলানো টাওয়ারটি ব্যবহার করেছিলেন। টাওয়ারের মাঝের ছাদ থেকে ঝুলে থাকা এক ঝাড়বাতি দেখে গ্যালিলিও তার বিখ্যাত দোলন সূত্রগুলোর কথা প্রথম চিন্তা করেন বলেও জানা যায়।  গিনি ও পালকের পরীক্ষার একটি অংশ তিনি দুটি ভিন্ন ভিন্ন ভরের কামানের গোলার সাহায্যে হাতে কলমে পরীক্ষা করেছিলেন পিসার টাওয়ার থেকেই। গ্যালিলিও খণ্ডন করেছিলেন বৈজ্ঞানিক এরিস্টটলের বক্তব্যের। এরিস্টটলের ব্যাখ্যা ছিল পড়ন্ত বস্তুর গতিবেগ তার ভরের ওপর নির্ভরশীল। যদিও এখানেই যে গ্যালিলিও পরীক্ষা করেছিলেন সেরকম কোনও বিশ্বস্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এই পরীক্ষার কথা মিনারের ফলকেও লেখা আছে। ভেবে দেখুন তো- সে কি আজকের কথা।গ্যালিলিও জন্মেছেন সেই কবে ১৫ ফেব্রুয়ারি,১৫৬৪ সালে।একদিকে তিনি দূরবীন দিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের দরজা খুলে দিচ্ছেন, আবার অন্যদিকে পিসার মিনারে এই যুগান্তকারী পরীক্ষা চালাচ্ছেন। মূলত এই কাহিনীটি সূচনা করেছিলেন গ্যালিলিওর এক ছাত্র ও তার সহকারী ভিনসেনজিও ভিভিয়ানি। এই ভিভিয়ানী তার গুরু গ্যালিলিওর আত্মজীবনী লিখেছিলেন।  চলেছি আমরা  মিরাকুলাস স্কোয়ার বা ক্যাথিড্রাল স্কোয়ারে। যাবার আগে 


আরেকটু বিজ্ঞানের কথা বলি । যেহেতু আমার চোখে চশমা তাই বলতেই হয় ।  সত্যিকারের চশমা বলতে যা বোঝায়, তা প্রথম প্রচলিত হয় ইতালিতে দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। ওই সময় চোখে আতশী কাচ লাগিয়ে ছোট জিনিসকে দৃষ্টিসীমায় নিয়ে আসার জন্য চোখে চশমা ব্যবহার করার নজির রয়েছে ইতিহাসে। ১২৮৬ সালের দিকে ইতালিতে প্রথম চশমা তৈরি হয়েছিল। জিওর্দানো দা পিসা নামের এক ব্যক্তি প্রথমবারের মতো চশমা তৈরি করেছিলেন। দা পিসার তৈরি চশমার উদ্দেশ্য ছিল দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার প্রতিকার।আধুনিক চশমার উদ্ভাবক হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে গিরোলামো সাভোনারোলা নামের এক ইতালীয়কে। তিনি ১৭২৭ সালে বর্তমান সময়ের চশমার প্রাথমিক নকশাটি তৈরি করেন। তার আগে দুই চোখের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা এড়াতে চোখের সামনে কাচ ধরা হতো।গিরোলামো  সাভেনারোলার নকশাটিকে স্থির রেখে এরপর চশমার নকশা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এটি পায় আধুনিক চেহারা। একদিকে দুটো দুটো আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল একই শহরে। 

        পিসায় আমার পরিচিত কয়েকজন  মানুষ আছেন । এরা সবাই বাংলাদেশর মানুষ । ওরা আমায় মামু বলে আমিও ওদের মামু বলি । পিসার প্রবেশ  করার আগে থেকে যত দোকান আছে সব দোকানে রয়েছে বাঙালি । কী সুন্দর ইতালীয় ভাষায় কথা বলছে,  জর্মন  বলছে , আবার বাংলা বলছে । মূল গেট পেরিয়ে চলে আসি পিসার প্রাঙ্গণে। 


            এবার একটু ইতিহাস বলি যে ভাবে সবাইকে গাইড করি  সেই ভাষাতেই বলি তা হলে আপনিও  ভাববেন পিসায় আছি ।  ইতালির পিসায় এ মিনারটি ঘন্টা বাজানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। এর এক পাশ হেলে থাকার কারণে সমগ্র বিশ্বে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও সুনাম রয়েছে। নির্মাণের শুরু থেকেই এই মিনারের এক দিক থেকে ক্রমশঃ হেলতে থাকে। বর্তমানে এ কাঠামোটিকে রক্ষা করতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করায় এর হেলে পড়া  থেকে রক্ষা করা গিয়েছে। একুশ বছর ধরে এর চতুর্দিকে অস্থায়ীভাবে মাঁচা তৈরি  করা হয়েছিল। ২৬ এপ্রিল, ২০১১ সালে এর সর্বশেষ মাঁচাটি সরিয়ে দেওয়া হয় । এর ফলে মিনারটিকে পুনরায় সঠিকভাবে দেখা যায়। ১১৭৩ সালে থেকে ৫৫.৮৬ মিটার (১৮৩.৩ ফু)মার্বেলের তৈরি মাটি থেকে অষ্টতলাবিশিষ্ট এ মিনারের উচ্চতা প্রায় ৫৬ মিটার। এর  ওজন প্রায় ১৪,৫০০ টন। বর্তমানে এটি প্রায় ৩.৯৯ ডিগ্রী কোণে হেলে রয়েছে। মিনারের ওঠার জন্য ২৯৪টি সিঁড়ি আছে।

১১৭৮ সালে মিনারটির তৃতীয় তলা নির্মাণের পর এটি হেলতে শুরু করে। নরম মাটিতে মাত্র তিন মিটার গভীরতায় এর ভিত্তি গড়ে তোলাই মিনারটির হেলে পড়ার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আসলে তিন মিটার গর্ত করে এতো বড় একটা মিনার রাখা যায় ? এছাড়া মিনারের নকশাও এজন্যে কিছুটা দায়ী ছিলো বলে মনে করা হয় । কাঠামোটির নির্মাণকার্য শতাধিক বছর বন্ধ ছিল। কারণ পিসার অধিবাসীরা প্রায়শঃই জেনোয়া, লুক্কা এবং ফ্লোরেন্সের সাথে যুদ্ধকর্মে লিপ্ত থাকতো।পিসার হেলানো মিনারটির প্রকৃত স্থপতি কে ছিলেন তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেক বছর ধরেই গাগলিমো এবং বোনানো পিসানোকে এর নকশাকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে বোনানো পিসানো ছিলেন দ্বাদশ শতকের সুপ্রসিদ্ধ পিসা নগরীর অধিবাসী ও শিল্পী। তিনি ব্রোঞ্জ দিয়ে গড়া পিসা দুমো'র জন্যেও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ১১৮৫ সালে পিসা ত্যাগ করে সিসিলি'র মনরিলে এলাকায় চলে যান এবং নিজ শহরে ফিরে আসা মাত্র দেহত্যাগ করেন। ১৮২০ সালে টাওয়ারের পাদদেশে তাঁর নামাঙ্কিত এক টুকরো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এটি ১৫৯৫ সালে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ক্যাথেড্রেলের ব্রোঞ্জের দরজার সাথে সম্পর্কিত ছিল। এছাড়াও,সাম্প্রতিককালের  গবেষণায় দেখা গেছে যে, দিওতিসালভি নামক এক ব্যক্তি পিসার হেলানো মিনারের প্রকৃত স্থাপত্যবিদ। এবার নিজের মতো করে দেখুন  ছবি  তুলুন । আমি একটু ধূমপান করে আসি । এসে ক্যাথেড্রাল, বেপ্টিসটেরি এবং সিমেট্রি এদিকটা  বলছি । আর একটা কথা বলে যাই মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন  সার্জেন্ট জার্মান বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করতে মিনারটিতে যান। তিনি মিনারের শৈল্পিক দক্ষতায় অভিভূত হন এবং ক্যাথেড্রালের  সৌন্দর্য্য উপভোগ শেষে সেনাবাহিনীকে মিনার আক্রমণ না করতে নির্দেশ দেন। এভাবেই মিনারটি নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি থেকে রক্ষা পায়। আর এটাই যদি না  থাকতো আমরা আসতাম না । 


        পেছনের গেট দিয়ে বেড়িয়ে  দাঁড়িয়ে আছি আর মিনারকে দেখছি । আমার সামনে একটা ট্রাম গাড়ি দাঁড়িয়ে ভেতরে গিয়ে বসলাম । এই গাড়ি করে শহর ঘুরে নেওয়া যায় । আমরা এই গাড়ি করে ঘুরবো না । কত প্রাচীন এই শহর । নিজেই একটা ছোট দেশ ছিলো । পরে  ইতালির অঙ্গ রাজ্য । ওইটুকু তো শহর, তবুও পিসা জন্ম দিয়েছে কত অসাধারণ ব্যক্তিত্বের। পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার জয়ী এনরিকো ফার্মি এবং কার্লো রুবিয়া, সাহিত্যের নোবেলজয়ী জিওসুয়ে কার্দুচ্চি যাকে ইটালির  জাতীয় কবি বলা হয় । মাটির কী গুণ আছে? হ্যাঁ মাটির গুণ আছে । আরো কতো গুণীজন মানুষের ভূমি এই পিসা। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পিসার অবদান চলেছে কোন সে সুদূর দিন থেকে।  বিশ্বের মানচিত্রে  পিসার মাথায় পালক দিয়েছে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়। এর প্রতিষ্ঠা  ৩ সেপ্টেম্বর, ১৩৪৩ সাল। 

  এখানে মানুষ  কত রকম ভাবে ছবি তোলার চেষ্টা তার শেষ নেই  । কেউ পিসাকে ঠেলে সোজা করার চেষ্টা করছেন (ছবিতে ) কেউ  শুয়ে পড়ছেন । অদ্ভুত এক মাদকতায় মেতে থাকা। সবুজ গালিচার মত মখমল ঘাসের প্রাঙ্গণ এই টাওয়ার স্কোয়ারকে পরিচিত করেছে বিশ্বের অন্যতম সুন্দর স্কোয়ারে , এমনকি ইতালির মতো দেশে যেখানে সুন্দর সুন্দর স্কোয়ারের ছড়াছড়ি প্রতিটি শহরেই, সেখানেই ধরা হয় পিসার স্কোয়ারের স্বর্গীয় সৌন্দর্যের সাথে কেউ পাল্লা দিতে পারে না  ।

         খু্ব সাদা চোখে যদি দেখা যায়  তাহলে বলি এটা হচ্ছে ক্যাথিড্রাল সম্প্রদায়ের চারণভূমি । ধর্ম প্রচার, ধর্মকে  

ধরে রাখার একটা নিজস্ব কৌশলগত ভূমি ছিলো । আর এই ধর্মকে ধরে রাখার জন্য কোটি কোটি টাকা তখন খরচ  করা হয়েছে । টাওয়ারের পর আমরা এগোলাম ক্যাথেড্রালের দিকে, যা কিনা পিসার লিনিং টাওয়ারের চেয়েও পুরনো। সুবিশাল স্থাপত্য, ভিতরে- বাহিরে জাকজমকের ছড়াছড়ি, বোঝাই যায় কি ঐশ্বর্যশালী ছিল যাজক সম্প্রদায়।

ক্যাথেড্রালের ছাদ দেখতে যেয়ে আক্ষরিক অর্থেই চোখ কপালে উঠে যায় , গোটা সিলিং সোনালী রঙের প্রলেপ দেওয়া ধাতব পদার্থে তৈরি, চারকোনা অসংখ্য ফ্রেমে দারুন সব গিল্টি করা কাজ।ভিতরটা বিশাল, চারিদিকে 


চিত্রকর্মের ছড়াছড়ি, মাঝখানে ছাদ থেকে ঝুলে থাকা এক ঝাড়বাতি। এর পরে ক্যাম্পোসানতো, অন্য তিন বিশালাকার অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারী স্থাপত্যের কাছে প্রথম দর্শনে একে বেশ ম্রিয়মাণ হলেও  এর আসল রহস্য হচ্ছে  এক দেয়াল ঘেরা সমাধি স্থল, অনেকের মতেই এত বিশ্বের সুন্দরতম ও বিচিত্রতম সমাধি হলঘর। ধারণা করা হয় চতুর্থ ক্রুসেড চলাকালীন সময়ে সুদূর গোলগাথা থেকে আনা পবিত্র মাটিকে কেন্দ্র করে এই অদ্ভুত আবেদনময়ী স্থাপত্যটি তৈরি হয়। আর্নো নদীর অববাহিকায়  অবস্থিত পিসা শহরের মাটি খুব নরম , মানুষ  জনও খু্ব ভালো । ইউরোপীয় দেশগুলোতে কোথাও আমি  রাস্তায়  জলের কল দেখিনি । পিসায় এসে বিনিপয়সায় কলের জল খেয়ে পিপাসা মেটালাম ।

মন্তব্যসমূহ

  1. তথ্য সমৃদ্ধ লেখা পড়ে,মনটা আনন্দে ভরে গেল।

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারণ!!পিসা দেখেছি কয়েক বছর আগে কিন্তু এত কিছু জানতাম ই না। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
    ডাঃঅচিন্ত্য কুমার পোদ্দার।ভিলাই।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ l আপনার লেখা খুব ভালো লাগে l

    উত্তরমুছুন
  4. দারুন লাগলো লেখাটা পড়ে ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম