ভেনিস প্রেমের শহর

ভেনিস প্রেমের শহর

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় ॥

প্রেমের শহর


যত পড়ছি , যত দেখছি , যত শুনছি  কেমন একটা ভাবনা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে । আর কোন দিন কী যেতে পারবো ভেনিসে? বিশ্বকরোনা মানচিত্রে তৃতীয় ওয়েব চলছে এখানে। কী ভাবে বর্ণনা করি তার মানবিক মুখ । সিটি অব লাভ  , কী শেষ হয়ে যাবে ? প্রেমের মৃত্যু নেই। প্রেম আবার ফিরে আসবে । যেভাবে বারবার ফিরে আসে ইটালিতে । প্লেগ , কালো ইঁদুরের থাবাও কিছু করতে পারিনি ইতালিকে । ১৯ জুলাই, ৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত বৃহদাকৃতির  অগ্নিকান্ড । এরফলে রোম নগরীর অধিকাংশ এলাকা আগুনে পুড়ে ছাঁই হয়ে যায়। রোমান সাম্রাজ্যেরপঞ্চম এবং জুলিও-ক্লদিয়ান  রাজতন্ত্রের সর্বশেষ রোমান সম্রাট হিসেবে ছিলেন নিরো। টাসিটাসের মতে, এ অগ্নিকাণ্ডের জন্য নিরো খ্রিস্টানদেরকে দায়ী করেছিলেন। কিন্তু অনেক রোমান অধিবাসী মনে করেন যে, নিরো স্বয়ং ডোমাস অরেয়া স্বর্ণ ভবন নির্মাণে আগুন লাগানোর আদেশ দিয়েছিলেন। সেই সময় নাকি নিরো প্রাসাদে বসে বেহালা বাজিয়ে ছিলেন ।


          রবীন্দ্রনাথ যূরোপ প্রবাসী পত্রে ইটালি এসে লিখেছিলেন , ইটালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত  সমস্ত রাস্তা নির্ঝর নদী পর্বত গ্রাম হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলেম । এই রাস্তাটুকু আমরা যেন একটি কাব্য পড়তে পড়তে গিয়েছিলেম ।

           আমি ফ্রান্স থেকে অনেক দেশ পেরিয়ে গিয়েছিলাম ইটালিতে। রাস্তায় পড়েছিল সুইজারল্যান্ড,  অস্ট্রিয়া,  লিচেস্টাইন। ইতালিতে যখন পৌঁছেছি  তখন সন্ধ্যে হয়েছিল। পরেরদিন আমরা একটা ফেরি করে ভেনিস  শহরে প্রবেশ করলাম। ভেনিস , পিসা , রোম এই নামগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে ভালোবাসা,প্রেম, সৌন্দর্য ,ইতিহাস , শিল্পকলা। কি দেখব , আর কি করবো , এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব বেড়ে যায় মনের মধ্যে! ভেনিস নয় এলাম আসলে ব্যাসিলিকার  ভেতরে । কি এক উৎকন্ঠা যেন সর্বদা পীড়িত করে রাখে ! ব্যাসিলিকা কি ? শহর? বন্দর?  নাকি শিল্পকলার অসামান্য এক পৃথিবী? ১২০৪ সালের 

সালের বাইজেন্টাইন বিগ্রহ। জাকজমকপূর্ণ গম্বুজ । ভেনিসিয়ান শাসকদের নবম শতাব্দীর প্রাসাদ । শিল্পকলার কথা বলতে গেলে কয়েক হাজার শব্দ আমায় লিখতে হবে। ইতিহাস এখানে প্রতিটি পাথরের গায়ে। শিল্প যেমন পাথরে পাথরে তেমনি মানুষ এখানে নিজেই শিল্প হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর সমস্ত পথ যেমন রোমে গিয়ে মিশেছে।  ভেনিসে  তেমনি সমস্ত প্রেমের প্রতিটি কুড়ি এখানে এসে ফুটে যাচ্ছে। প্রাণোচ্ছল মানুষের এক অদ্ভুত উন্মাদনা।


ইটালির মেয়েদের বড় সুন্দর দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের মেয়ের ভাব আছে সুন্দর রং কালো কালো চুল কালো ভুরু  কালো কালো চোখ আর মুখের গড়ন অতি চমৎকার।

             এখানে সৌন্দর্যের পূজা হয় এখানে রূপ কোনমতে গুপ্ত থাকতে পারেনা, রূপাভিমান সুপ্ত থাকতে পারেনা, চারিদিক থেকে প্রশংসার কোলাহল তাকে জাগিয়ে তোলে রূপের আলো মাত্র ভক্তদের পতঙ্গ হৃদয় চারিদিক থেকে ঝাঁকে  ঝাঁকে তাকে ঘিরে ফেলে ও রূপসী যে দিকে যান সেই ফড়িংয়ের দল তার চতুরদিকে লাফালাফি চলতে থাকে। আমি নই রবি ঠাকুর যেভাবে মেয়েদের দেখেছেন  সেটাই আমি লিখলাম । এখানেই শেষ নয় য়ুরোপের মেয়েদের কথা বলতে গিয়ে  তিনি  বলেন ,  ' ' ' তার রুমাল কুড়িয়ে দেওয়ার জন্য শতশত হাত প্রস্তুত। তার তিলমাত্র কাজ করে দেওয়ার জন্য শতশত কায়মনোবাক্য দিবারাত্রি নিযুক্ত।'  আমিতো ভারতেরই মানুষ তার ওপর আবার বাংলার মানুষ আমার মধ্যে সেই আবেগ প্রেম দেখার একটা চোখ সবসময় খুলে যায়। সিটি অফ লাভ কেন বলা হয় ভেনিসকে সেটা না দেখলে বোঝা যায় না।মাকড়সার জালের মত পুরো ভেনিস জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য খাল । এরই মাঝে শহরকে দ্বিখন্ডিত করেছে গ্র্যান্ড ক্যানেল। ভেনিস শহরটির মতো নান্দনিক শহর পৃথিবীতে খুব কমই আছে। ভেনিসে নেই কোনো কোলাহল, নেই যান্ত্রিক ব্যস্ততা। প্রশান্তির চাদর বিছিয়ে রাখা পুরো শহরময়।আদ্রিয়াটিক সাগরের উপকূলে ইতালির ভেনিটো অঞ্চলে বো ও পিয়াভব নদীর মিলনস্থলে প্রায় ৪১৭.৫৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত ভেনিস। ৩ লাখ নাগরিক বুকে ধারণ করেছে ভেনিসের ১১৮টি ছোট ছোট দ্বীপ। ১৭৭টি খাল আর এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে পায়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য রয়েছে ৪০৯টি সেতু। এইসব সেতুর তলা দিয়ে চলেছে গন্ডোলা । গন্ডোলাই হচ্ছে এক অর্থে সিম্বল অফ ভেনিস । জলের ভেতর বাড়ি । বাড়ির মধ্যে বাধা আছে ছোট্ট নৌকা । ভেনিস  এসে এমন কোনো মানুষ নেই যিনি গন্ডোলায় চাপেন নি ।  ১৫০০ এর দশকে সব ধরণের আনুমানিক ১০০০০গন্ডোলার ভেনিসে ছিল;  ১৮৮০সালে আনুমানিক ৪০০০ এবং এখন প্রায় ৪০০। ২০ ২১ নভেম্বর মাস থেকে কিছু গন্ডোলা আবার চালু হয় । গন্ডোলায় বসলেই আমার সেই বিখ্যাত গানটা মনে পড়ে যায় । যেখানে অমিতাভ আর জিনাত আমন গেয়ে ছিল আমারে মিয়.....। গন্ডোলায় বসে ৪০ মিনিট প্রেমের সুর তরঙ্গে ভেসে বেড়াবেন ।  


১৭০টির মতো বড় বড় বাড়ি আছে এই নগরীতে। আছে পুরনো বন্দর, নানা কাজে ব্যবহৃত বড় অফিস ও বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। বাড়িগুলোর কারুকার্য আর স্থাপত্যশৈলী দেখলেই যে কারও নজর জুড়িয়ে যেতে বাধ্য।ব্রিজ থেকে ক্যানেল বা খালের দৃশ্যটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। প্রচলিত আছে প্রেমিক প্রেমিকারা সূর্যাস্তের সময় ব্রিজের নিচে উপস্থিত হন। ক্যাম্পানাইল গির্জায় ঘণ্টাগুলো বাজার সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরকে চুম্বন করলে তারা স্বর্গীয় ভালোবাসা লাভ করে। প্রচলিত এই মিথ আর খালের দুই পাশে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রূপ নকশায় সাজানো বাড়িগুলোর পর্যটকদের টানে অন্যরকম মাদকতায়। আর তাইতো সেতুর নিচে দিয়ে গন্ডোলায় চড়ে ভ্রমণ করার মজাই আলাদা । 

স্বপ্নের শহর ভেনিসকে অন্য দুনিয়ার মূর্তি বললেও ভুল হয় না। বিশেষ থিমে বানানো মুখোশ পরে পালিত হয় প্রধান দুই উৎসব। ভেনিসের রংবেরঙের মুখোশগুলো এমনিই জগদ্বিখ্যাত। তার ওপর ফেস্টিভ্যালের সময় দর্শনীয় চিত্র-বিচিত্র সব মুখোশ শোভা পায় প্রায় সবার মুখে। সারা বছরই চলে তার বিকিকিনি। হরেক রকমের মুখোশ পরে লোকজন উৎসব পালন করে। যারা মুখোশ তৈরি করে তাদেরও একটা আলাদা সম্মান আছে সমাজে। এই মুখোশের কোনটা পাখির ঠোঁট, কোনটা বিশালাকৃতির, কোনটা পালকময় আবার কোনোটা মুখের অবয়বে তৈরি।


    আমি যত গুলো মুখোশের দোকানে গেছি । প্রায় সব দোকানের মালিক বাঙালি । এ যেন বুক ভরা নিঃশ্বাস  নেওয়া । বাংলাদেশের মানুষ । কতো গল্প  মামুদের সাথে । ভুলে যেতে হবে কোথায় আছি । দু দুবার গেছি । মুখ ও আছে মুখোশও আছে । এবছর যাব সেরকম ভাবে আমার  টিকিট কাটাও ছিলো । সম্প্রতি আমার এক বন্ধু দাদা একটি ভিডিও পাঠিয়েছেন ভেনিসের উপর । তাতে দেখলাম , সমস্ত দোকান পাট বন্ধ । যে দোকানে বসে কফি খেতাম সে দোকানটিও দেখলাম । মনের ভেতরে হু হু করছে ।  মানুষজন নেই । শুনছি ভেনিস এখন অন্ধকার নগরী হয়ে উঠছে করোনার থাবায় । কয়েক দিন আগে একদল বিদেশী পর্যটক গিয়েছিলেন ভেনিসে তার মধ্যে কয়েকজন সংবাদিকও ছিলেন । তারা জানিয়েছেন এই মুহূর্তে ভেনিস খুব ভালো নেই । তবে আশা করা যাচ্ছে । তৃতীয় ঢেউ কাটিয়ে ভেনিস আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসবে । এখনো  কী নিরো তার প্রাসাদে বসে বেহালা  বাজাচ্ছেন ? পৃথিবী আবার শান্ত হবে ভেনিসের দালানে বসে আমরা আবার মুখোশ নয় ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো অজানা প্রেমিকার জন্য ।


মন্তব্যসমূহ

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. তোমার লেখায় ভেনিসকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম মনেহলো

    উত্তরমুছুন
  3. ভ্রমণ কাহিনী শুধুতো ভ্রমণের বিবরন নয়, তার ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি সব নিয়ে একটা কাহিনী। তার সাথে যদি লেখকের অনুভুতির আবেগ পাঠককে স্পর্শ করে সেটা হয়ে ওঠে জীবন্ত। সেই স্বাদ পেলাম তোমার লেখায়। খুব সুন্দর।

    উত্তরমুছুন
  4. দারুন লাগলো , অপেক্ষায় রইলাম....

    উত্তরমুছুন
  5. আপনার লেখা খুব যত্ন সহকারে পড়ি আমি। কতো সুন্দর ভাবে লেখেন ,কতো সুন্দর আপনার চিন্তাধারা।আপনার লেখা অমর হয়ে থাকবে আমাদের মনে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. ধন্যবাদ জানাই আপনাকে ॥ ভালো থাকবেন ভালো রাখবেন সবাইকে ॥

      মুছুন
  6. আপনার লেখার মধ্য দিয়ে ভেনিসে মানস ভ্ৰমণ করলাম l চোখের সামনে ভেসে উঠলো অপূর্ব সুন্দর ভেনিস l

    উত্তরমুছুন
  7. অসাধারণ, সাবলীল ভেনিসের সৌন্দর্য বর্ণন।যারা অতীতে কখনো ভেনিস দেখেছেন,এই লেখার মধ্য দিয়ে যেন দ্বিতীয় বার ভেনিসদর্শন হয়ে গেল তাদের। অসংখ্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম