তুঙ্গনাথ
তুঙ্গনাথের পথে
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়
তাঁরা কি জানে সে কি চায় ? তাঁরা জানতো বলেই হয়তো অনেক কিছুই পেয়েছে । চাওয়া আর পাওয়ারা মধ্যে একটা টান আছে । তবে বিশালতাকে ধরার জন্য যে টান দরকার তা আমার মধ্যে উপলব্ধিতে আছে, ধরার ক্ষমতা নেই । টান আছে বলেই আমায় টেনে নিয়ে গেছেন । ধুতি পড়া একজন বাঙালি মানুষ । টুক টুক করে হেঁটে চলেছেন দোগলভিটার রাস্তায় । বাড়িটা তিনি এখানেই করেছিলেন হিমালয়কে আরো নিবিড় ভাবে দেখার জন্য । ছোট বেলায় এই মানুষটার স্বপ্ন দেখতাম । তিনি দোগলভিটার রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছেন , ওটা চৌখাম্বা। পাশে শিবলিঙ্গ এই ভাবেই স্বপ্নে আমায় দেখাতেন । সেই মানুষটার নাম উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।হিমালয়ের পথে পথে পড়ে পড়ে মুখস্ত করে ফেলেছিলাম।সেটাই মনে মনে সারাদিন ভাবতাম আর সেটাই স্বপ্নে দেখতাম । হিমালয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল পাঁচ বছর বয়েসে । আর হিমালয়কে হাতে ধরে আমায় চিনিয়ে ছিলেন আরো এক ধুতি পড়া মানুষ তাঁর নাম নিমাই অধিকারী । তিনি ছিলেন আমার বাবার বন্ধু । ছোট বেলায় লাইব্রেরীতে আমাদের বেছে বেছে বই দিতেন। সেই মানুষটিই আমায় হিমালয় চিনিয়ে ছিলেন ।হিমালয়ের কত অচেনা জায়গায় নিয়ে গেছেন । কি ভাবে দেখতে হবে হিমালয়কে , কি ভাবে ভালোবাসাতে হয় পাহাড়কে। সবই চিনেছি তাঁর হাত ধরে । গাছ দেখে বলে দিতেন কত হাজার ফুট উপরে আমরা আছি । মহাভারত আর রামায়ণকে মিশিয়ে গল্প বলতে বলতে নিয়ে যেতেন । পথের ক্লান্তি ভুলে যেতাম তাঁর গল্পে ।
তুঙ্গনাথের মন্দির ছবি তাপস কুমার দত্ত |
দিক আমি ভুল করিনি । দর্শন ভুল হতে পারে । একই দিনে দুবার কেদারে হেঁটেছি । কারণ ছিলো একটাই মানুষকে পৌঁছে দেওয়া । কারুর ব্যাগ বয়ে দিয়েছি আবার কাউকে হাত ধরে ধরে এগিয়ে দিয়েছি । দিকদর্শন যদি একসাথে বলি তা হলে পঞ্চপান্ডবও খুঁজে পাননি শিবকে। নারদ পথ দেখালেন কিভাবে খুঁজতে হবে মহাদেব কে। মহিষ রূপে শিবের দর্শন পেয়েছিলেন শেষবেলায়। শিব জানতেন ওরা কি চায়। জানতো বলেই হয়তো অনেক কিছুই পেয়েছিলেন পঞ্চপান্ডব। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে অর্জুন যেখানে শিবকে পেয়েছিলেন আমরা যাব সেই পথে। বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন ছিলেন সুন্দরের পূজারী । ভাইদের মধ্যে বীরশ্রেষ্ঠ বলেই হয়তো সবচেয়ে উঁচু অঞ্চলে তাকে শিবের পুজো করতে হয়েছিল।
সামনেই চৌখাম্বা । ছবি তাপস কুমার দত্ত |
গুপ্তকাশীর উল্টো দিকে উখিমঠ। দূর থেকে নেমে আসছে বালখিল্য নদী। ওই যে পাহাড়ের কোলে লাল বাড়িটা মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি পড়ে যাবে, ওটাই ভারত সেবা সংঘ। আমাকে যেতে এই পথ দিয়ে । এই পথের নাম ভুখা হরতাল । সারাদিনে একটাই বাস যাতায়াত করে গৌরীকুণ্ড থেকে বদ্রিনারায়াণ আর বদ্রিনারায়াণ থেকে গৌরীকুণ্ড। উখিমঠ, কালীমঠ, মস্তূরা, মূক্কূুমঠ হয়ে দোগলভিটা পেরিয়ে চোপতা । পুরো পথটাই কেদার স্যাংচুয়ারি। বনবিভাগের অধীনে । কেদারনাথ থেকে নেমে এসে গুপ্তকাশী মন্দির দেখে, পরের দিন সকাল বেলা রওনা দিলাম চোপতার দিকে। মাত্র ৪৫ কিমি পথ .কিন্তু সময় লেগে যায় তিন ঘন্টার বেশি । চোপতা যাবার পথটা ভয়ঙ্কর সুন্দর । জঙ্গল। জঙ্গল শেষ হলে বুগিয়াল । নিস্তব্ধতার মাঝে মাঝে, সৌন্দর্যের বাতাবরণ । গাছের ফাঁক দিয়ে দূরে আকাশের গায়ে বরফের আকাবাঁকা রেখা । পাখি ডাকলে স্তব্ধতা ভেঙে যাচ্ছে । চাপ চাপ সবুজ ঘাসের ঢেউ । রডোডেনড্রন ফুলের গন্ধ কি আছে আমি জানিনা। কিন্ত একটা সুন্দর গন্ধ পাচ্ছি সারা রাস্তায় যা কিনা জঙ্গলের গন্ধ নয় । কত রকমের রডোডেনড্রন ফুটে আছে রাস্তার দুধারে । মে মাস তখনও বরফ রয়েছে রাস্তার আসে পাশে ।
তুঙ্গ নাথের যাবার পথ ॥ছবি তাপস কুমার দত্ত |
চোপতা গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে তিনটে বেজে গেছে। তার কারণ অবশ্যই আমরাই । রাস্তায় অনেক বার থামাতে হয়েছিল দেখার জন্য । আমরা দুই বন্ধু গিয়ে উঠলাম মঙ্গল সিং এর দোকানে । বৃষ্টি পড়ছে ঝিমঝিম করে তার সাথে বরফের কুচি ও পড়ছে। কেদারনাথের থেকেও ঠান্ডার তীব্রতা অনেক বেশি মনে হচ্ছে । আমার সাথে মঙ্গল সিং এর চেনাজানা নেই । কিন্তু যেভাবে হেসে আমাদের ডেকে নিলেন মনে হলো কতদিনের আলাপ । উনি না চিনলেও আমি তাঁকে চিনি উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বই এর মাধ্যমে । বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ছে। ঠান্ডা আরো জাঁকিয়ে বসছে। চারিপাশে বরফে বরফ । বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না । ঘরের মধ্যে বিচুলি পাতা তার উপর চট । চটের উপরে কম্বল । সামনে দিকটা খোলা । চট টাঙিয়ে শীতকে আটকানো চেষ্টা । যেন প্রকৃতির কাছে নতজানু হয়ে পেতে বসেছি। এর মধ্যে দুকাপ চা খেয়ে ফেলেছি । রাতে আমাদের জন্য হচ্ছে খিচুড়ি । যা হচ্ছে হোক । চিন্তা বাড়ছে রাত কি ভাবে কাটবে ? ৯৫০০ ফুট উচ্চতায়র ঠান্ডা , আর যে হারে বরফ পড়েছে কাল যেতে পারবো কিনা ? আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে ভোররাতে বেড়িয়ে যাবো। আগে চন্দ্রশিলা দেখে তুঙ্গনাথে বাবাকালী কমলির ধর্মশালায় থাকবো । মঙ্গল সিং আমাদের পরিকল্পনা পাল্টে দিলেন । কাল তুঙ্গনাথে গিয়ে থাকো । পরের দিন চন্দ্রশিলা দেখে ফিরে এসো । মঙ্গল সিং আমাদের আরো একটা করে কম্বল বের করে দিলেন । আমরা সোয়েটার মোজা মাফলার কোন কিছু না খুলেই ঢুকে পড়লাম কম্বলের ভেতরে ।
পাহাড় চোখের সামনে ॥ছবি তাপস কুমার দত্ত |
কিভাবে যাবেন : ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই যোগাযোগ আছে হরিদ্বারে সাথে । অথবা বিমানে জলি গ্রন্ট এয়ারপোর্ট দেরাদুন বিমানবন্দরে হয়ে আসতে পারেন। হরিদ্দার ঋষিকেশ বা দেরাদুন থেকে চোপতা যাবার বাস নেই। হরিদ্বার থেকে বাসে করে উখিমঠ বা গুপ্তকাশী পর্যন্ত আসে যায় । সেখান থেকে জীপ যাচ্ছে চোপতা পর্যন্ত । প্রথম রাজ হরিদ্বার থেকে পরদিন ভোর বেলা রওনা হওয়াটাই ভালো । চোপতাতে এক রাত থেকে পরেরদিন ভোরে রওনা দিন তুঙ্গনাথ এর পথে । ৩.৫ কি. মি হাঁটা পথ । হাটতে না পারলে ঘোড়ায় যেতে পারেন ।
এই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনDarun laglo
উত্তরমুছুনঅসাধরন একটি লেখা। খুব ভাল লাগলো ।
উত্তরমুছুনদারুণ লেখা
উত্তরমুছুনআপনার প্রতিটি লেখাই অসাধারণ 💐💐
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ
মুছুনমনমুগ্ধকর লেখা 🙏
উত্তরমুছুনKhub valo bhalo lage
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুনখুব সুন্দর , পড়ে আনন্দ পেলাম 🙏
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা নেবেন
মুছুনঅপূর্ব লেখনী আপনার ! সশরীরে যাবার সাধ্যি নেই । কিন্তু মন ভরে গেলো আপনার লেখা পড়ে ।
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুনখুব ভালো লাগল।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা
মুছুনঅসাধারণ। চমৎকার মানস ভ্রমণ হলো। আপনার ব্যবস্থাপনায় হাঁটা ওই পথের ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠলো হঠাৎই । ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুন
উত্তরমুছুনতুঙ্গনাথে পথের প্রাকৃতিক শোভা বর্ননায় অতৃপ্তি লাগছে।মন বলছে আরও চাই.....।🙏
আমার শুভেচ্ছা নেবেন
মুছুনNice
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনNice
উত্তরমুছুনDarun
উত্তরমুছুন