লাল কাঁকড়া বীচ

 লাল কাঁকড়ার ঘরে 

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় ॥

মন্দারমণি যাবার জন্য চাউল খোলা মোড়ের কাছে  দাঁড়িয়ে আছি । দীঘার থেকে প্রায় ২৪ ,কিমি আগে এই মোড়ে দাঁড়িয়ে পুজোর কটাদিন দেখলাম কী হারে গাড়ি যাচ্ছে আর আসছে । আমার অবশ্য মন্দারমণি যাবার ইচ্ছে নেই, কাছে পিঠে  যদি একটা নিরিবিলি বীচ পাওয়া যায় তা হলে নিজের সাথে নিজের একটু কথা বলা যায় ।কী কথাই বলবো । বাড়ি ফিরে মনে হবে বেশি কথা হলো ।লোকে বলবে মূর্খ বড়ো সামজিক নয় । কোথায় যাই? একজন বলেছিলো লাল কাঁকড়া বীচ গেলে আপনি একা থাকতে পারবেন । আমি মনকে বললাম চলো নিজ নিকেতনে ।

ঝাউ গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য নিভে যাচ্ছে 

চাউল খোলা থেকে একটা অটো নিলাম। ২০০ টাকা দিয়ে। মাত্র ৯ কিমি রাস্তা ২০০ টাকা! অগত্যা মধুসূদন ! ভাবি আমাদের গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি ।  মেদিনীপুরের লাল মাটি রূপ এখানে নেই। রাস্তার দুই ধারে পুকুরে  হাঁস চই চই । রোদে শুকাতে দেয়া হয়েছে শুটকি মাছ । মোড়ের মাথায় বাগদা আর গলদা চিংড়ির দোকান । এক জায়গায় লেখা রয়েছে বিভিন্ন রকম কাঁকড়া পাওয়া যায় । আমি তো সেভাবে ভেরি দেখতে পাচ্ছি না । ৫ কিলোমিটার যাওয়ার পরেই প্রকৃতি একটু পাল্টাতে শুরু করলো । একটা সমুদ্র সমুদ্র পরিবেশ দেখতে পাচ্ছি আকাশের গায়ে । গাছপালার পরিবর্তন হতে শুরু করল । অটো ভাই আমায় বল্লেন এটাই আপনার হোটেল । 

এ কোথায় এলাম ? বাড়ি একটা । বাড়ি মাত্র ? এটা আমার হোটেল? আমার চিন্তায় কোন কারণ কেন। একটু নিচে দেখি হলুদ ,কমলা রঙের টেন্ট সাজান । মনটা আনন্দে ভরে গেল । এরকম টেন্টে তো  পাহাড়ে থেকেচি, গ্রামের ভেতরে? চারিপাশে ধানক্ষেত । তাল গাছ । ধানক্ষেত  দিয়ে একটু হাঁটলে সমুদ্রের রেখা ।

নির্জন বিচ 

 আমি মাছ মাংস খাই না । দুপুর বেলা বাগদা চিংড়ি দেখে পাশে বসা অল্প বয়সী ছেলে- মেয়েদের  মনটা ভরে গেলো। আমি আলু পোস্ত, আলু ভাজা দিয়ে খেয়ে নিলাম । আমি একটা হলুদ রঙের টেন্টে আছি । দুপুরের ভাত ঘুম দিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়ে লাল কাঁকড়া বীচের দিকে । একপাশে টমেটো ক্ষেত, ধান সবে পাকাতে শুরু করেছে । আকাশের গায়ে নরম আপেলের রঙ । ঝাউ গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য নেমে যাচ্ছে ।অল্প পাকা ধানের মাথায় লালের বর্ণছটা । এক রমণী পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন , তার রুক্ষ মুখে অবীরের প্রলেপ ।বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপখুঁজিতে যাইনা আর : অন্ধকারে জেগে উঠে।

জোড়া তাল গাছের পাশ দিয়ে বালির বাঁধ । নেমে গেলাম সমুদ্রের কাছে । নিস্তব্ধতার মধ্যে এক গর্জন । সমুদ্রের নিজস্ব রূপ দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে বীচকে । ঢেউয়ে পাগলা রূপ নেই । ছোট ছোট ঢেউ , বুকের ভেতর আচর কেটে দিচ্ছে । যতদূর চোখ যায় চেয়ে দেখি সমুদ্রতট । কোথায় লাল কাঁকড়া ? তাকে তো দেখি নাই ফিরে ? তার বদলে দেখছি সন্ধ্যে হয়ে আসা আকাশের নিচে কিশোর ছেলেরা ক্রিকেট বল নিয়ে ব্যস্ত । 

লাল কাঁকড়া বিচ 

ভোরে ওঠা আমার হয় না। সেই জন্য ভোরের রূপ আমি দেখিনি । শুনেছি ভোরবেলা নাকি লাল কাঁকড়া বিছে কাঁকড়া দেখা যায় । সকালের প্রাতরাশ সেরে  রামকৃষ্ণ মিশনে গেলাম । সেখান থেকেই  বিচে যাব । এই বিচে আরেকটি  নতুন টেন্টে থাকার জায়গা হয়ে গেছে । আমি যে টেন্টে আছি তারই জমির মালিক সুব্রত প্রধান করছেন। এখানে বীচ ড্রাইভ, বীচ ভলিবল,বোটে করে গিয়ে মাছ ধরার ও ব্যবস্থা করছেন। ভাবছি ডিসেম্বরে এসে মাঝ সমুদ্রে গিয়ে ছিপ দিয়ে মাছ ধরবো । বীচের কাছে চলে আসি । এ কী দেখছি । লাল শিমুল গেরুয়া পলাশের পাপড়ি দিয়ে বীচটাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । হাওয়াতে ফুলের পাপড়ি গুলো বিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে । কাছে গেলে আমার ভুল ভাঙে । এই তো সেই লাল কাঁকড়ার দেশ যার জন্য এখানে আসা । হাজারে হাজারে লাল কাঁকড়া নিজস্ব খেলায় মত্ত । আমি ওদের বিরক্ত করতে চাইনা । আপন মনে সৈন্য বাহিনীর মতো যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়েছে । মানুষের পায়ের শব্দে তারাও প্যারেড করে ঢুকে পড়ছে নিজস্ব আস্থানায় । আমার অবস্থা অনেকটা অস্ত্র ছাড়া যুদ্ধ করতে যাওয়ার মত । কাছে কোন ক্যামেরা নেই।  আছে একটা মুঠোফোন । তা দিয়ে কি লাল কাঁকড়ার ছবি তোলা যায় ? পুরুষোত্তমপুরে নিজের ভালোলাগাটা মাথায় বন্দি করে নিলাম । লাল কাকড়ার পেছনে ছুটতে ছুটতে এক কিমি চলে গেলাম । ভালোলাগার কোনও রকম ফের নেই । কখন যে লাল কাঁকড়াকে ভালবেসে ফেলেছি তা আমি নিজেও জানিনা এ এক অদ্ভুত নেশা লাল কাঁকড়ার পেছনে ছোটা। কখন যে দুপুর দুটো বেজে গেছে আমার খেয়াল নেই । সমুদ্রের গরম গরম হাটু জলে অবগাহনে নিজেকে ডুবিয়ে রাখি । 

থাকার ব্যবস্থা 

ঠান্ডা নেই, সন্ধের শিশির কিন্তু ঘাসের মাথায় দেখা যাচ্ছে । আজ টেন্টের অন্যান্য গেষ্টরা বারবিকিউ করবে । হোটেলের ছেলেরা আগুন জ্বালিয়ে ফেলেছে । অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা আগুনকে ঘিরে ফেলেছে । সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাচ্ছি । অন্ধকারে অন্ধকার নেই । আজ পূর্ণিমা। আকাশের পাশ থেকে বড় একটা চাঁদ উঠেছে ।  আর সেই চাঁদের আলোয়  জোড়া তালগাছ চকচক করছে । টেন্ট গুলো যেন আগুনের মত ঝলমল ঝলমল করছে, এমনি আলো দিয়ে সাজানো । চারিপাশের পরিবেশ থেকে ঝি ঝি পোকার গান ভেসে আসছে । চাঁদের আলোয় পুকুরের মাছেরা খেলা করছে । আমি একাকী । পাশের টেন্ট থেকে ভদ্রলোক বলে গেলেন : এখানে রাতে  শব্দের নীরবতা দিয়ে  গান হয় । আমি কান পেতে রাখি। সত্যিই রাতে গান শুনি ঝাউ পাতাদের । আমি তাদের বলি ঘুমিয়েছ ঝাউ পাতা ? এবার আমি শুতে যাব ।

কি ভাবে যাবেন : কলকাতা থেকে শুধু নয় রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাস ছাড়ে দিঘা যাবার । সেই বাসে গিয়ে নামতে হবে চাউলখোলা মোড়ে ।সেখান থেকে অটো নিয়ে যেতে হবে লাল কাঁকড়াবীচে। গ্রামের নাম পুরুষোত্তমপুর । 

কোথায় থাকবেন : রামকৃষ্ণ মিশনের  থাকার জায়গা আছে ।       এছাড়া সমুদ্রের তীরে থাকার জন্য প্রাইভেট টেন্ট পাওয়া যায়। 


মন্তব্যসমূহ

  1. টেন্টে থাকার খরচ কেমন?টেন্টে টয়লেটের কি ব্যাবস্থা আছে?

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. মাথা পিছু থাকা খাওয়া নিয়ে পনেরশো টাকা । কমন টয়লেট ।

      মুছুন
  2. খুব খুব ভাল লাগল । অসাধরন লেখা ।

    উত্তরমুছুন
  3. খুব সুন্দর বর্ণনা,যাওয়ার ইচ্ছে থাকলো।

    উত্তরমুছুন
  4. ফোন করে বুকিং করার কোনও ব্যাবস্থা আছে?

    উত্তরমুছুন
  5. স্যার আপনার লেখাগুলি ভীষণরকম প্রাণবন্ত, ভীষণ উপভোগ করি। খুব ভালো থাকবেন ।

    উত্তরমুছুন
  6. একটা বর্ষা মুখর দিনে প্রকৃতির রূপ দেখবো বোলে, বেরিয়ে পড়েছিলাম দুজনে। কি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বিভু মহারাজ এর অতিথিয়েতা ভোলার নয়।
    লেখা খুব ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন
  7. একটা বর্ষা মুখর দিনে প্রকৃতির রূপ দেখবো বোলে বেরিয়ে পড়েছিলাম দুজনে। অসাধারণ সে অভিজ্ঞতা। লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো। উস্কে উঠলো পুরোনো no স্মৃতি। খুব ভালো।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম