পালিতানা
মন্দিরের শহর পালিতানা
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়
পালিতানাকে বলা হয় পশ্চিমের কাশী। কাশীর পর পালিতানাই নাকি একমাত্র শহর যেখানে সবচেয়ে বেশি মন্দির আছে। ভাবনগর থেকে ৫৬ কি.মি. দূরে। আমরা গেছিলাম লোথাল থেকে। লোথাল থেকে যে বাস ধান্দুকা, ভিল্লাভিপুর হয়ে আসছে সেই বাসে। পালিতানা যাবার ২৩ কি.মি. আগে শ্রীহরে বাসটি থেমে গেল। অনেকটা পাহাড়ি শহরের আদল। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে ভাঙা ফোর্টের অংশ। আর টিলার মাথায় মন্দির। বেশিরভাগ মন্দিরই জৈন মন্দির। শ্রীহর থেকে আর ৮ কি.মি. দূরে শোননগর। শোননগরেও রয়েছে জৈন মন্দির।পালিতানা যাবার রাস্তার দুপাশে তৈরি হচ্ছে আরও নতুন জৈন মন্দির।
পালিতানা বাসস্টেশনে এলেই বোঝা যায় জৈন শহরে এসেছি। বড় বাসস্টেশনের মাথায় রয়েছে মহাবীর জৈনের একটি ফ্রেস্কোর কাজ। অপূর্ব কাজ। গুজরাটের বিভিন্ন বড় বাসস্টেশনগুলিতে রয়েছে বড় বড় ম্যুরালের কাজ। পালিতানা শহর থেকে শত্রুঞ্জয় পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় চার কি.মি.। শহর থেকে টাঙ্গা বা অটো যাচ্ছে । শত্রুক্ষয় পাহাড়কে ঘিরে রেখেছে শত্রুঞ্জয় নদী। পাহাড়ের মাথায় রয়েছে অসংখ্য জৈন মন্দির। মন্দির শুরু হয় পাহাড়ের কোল থেকেই। জৈন তীর্থের মধ্যে এটি ৫টি তীর্থ। পরেশনাথ, গিরনার, গোয়ালিয়র, আবু পর্বত এবং পালিতানা। পালিতানাকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ জৈন তীর্থ। গোয়ালিয়র বাদে প্রত্যেকটি তীর্থক্ষেত্র দেখে মনে হয়েছে, এদের মধ্যে পালিতানাই শ্রেষ্ঠ। বলা হয় এরকম ছবির মতো তীর্থক্ষেত্র নাকি ভারতে আর নেই। মন্দিরের পাশ দিয়ে শত্রুঞ্জয় পাহাড়ে ওঠার রাস্তা মানে সিঁড়ি। উঠতে হবে পাহাড়ের মাথায় যেখানে | রয়েছে ৮৬৩টি মন্দির। সিঁড়ি ভাঙতে হবে প্রায় | দুহাজার। সূর্য ওঠার আগেই আমরা হাঁটা শুরু করি। পাহাড়ের চূড়ায় যাবার জন্য ঘোড়া না থাকলেও কাণ্ডি ও ডাণ্ডি আছে । সময় লাগে ২ ঘণ্টার একটু বেশি। রাস্তার দূরত্ব মাত্র ৪ কি.মি.। সিঁড়ি না থাকলে সময় কম লাগত। খুব ছোট ছোট পদক্ষেপে উঠতে হয় । বড় জৈন মন্দির থেকে ২ মিনিট হাঁটলেই চোখে পড়ে নেমিনাথের সুন্দর মন্দিরটি। একদম পাহাড়ের কোলে চারতলা মন্দির। চারপাশ দিয়ে মন্দিরে ওঠা যায়। মন্দিরের মাথাটি সবুজ ঘাসের মতো। ত্রিভুজাকৃতির এই মন্দিরটির ভেতর রয়েছে প্রচুর ছবি। আবার এগিয়ে চলা। সিঁড়ির দুপাশে নিমগাছ। শত্রুঞ্জয় নদীকে দেখা যাচ্ছে। ভোরের দিকে নির্মল বাতাস সারা পাহাড়ে। রাস্তায় জলের অভাব নেই। প্রতি আধ কি.মি. অন্তর পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। খুব অবাক করে এই শুকনো পাহাড়ে রয়েছে চারটে কুণ্ড, গরমেও এই কুণ্ডগুলি শুকিয়ে যায় না। রাস্তায় কোনও খাবার দোকান নেই ত শুকনো খাবার থাকাটা প্রয়োজন। ইচ্ছাকুণ্ড এবং কুমারকুণ্ড পেরিয়ে কিছু দূর যাবার পর পালিতানা পাহাড়ের মাথা দেখা যায়। মাথায় মূল মন্দির নয়, আনন্দজী কল্যাণজী মন্দিরটির চূড়া ও গেট দেখা যায়। দূর থেকে মনে হয় একটি দুর্গ। দুর্গের পাশের রাস্তা দিয়ে মিনিট দশেক হাঁটার পরই জৈন তীর্থঙ্কর শ্রী আদীশ্বরের মন্দির। গেট দিয়ে ঢোকার পর শুরু হয়ে যায় মন্দির চত্বর। মন্দির আর মন্দির- যেন মন্দিরের ঢেউ। যে দিকে তাকাই ছোট-বড় মন্দির, মন্দিরের খাঁজে খাঁজে বিভিন্ন মূর্তি। কোথাও হাতির মূর্তি, কোথাও বিভিন্ন দেবতার মূর্তি। একদিনে এত মন্দির কারুর পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। শুধু মন্দির হলে হয়তো এত আকর্ষণ থাকত না। ৯০০ বছর ধরে এই মন্দিরগুলি তৈরি হয়েছিল। শ্বেতপাথরের এই মন্দিরগুলির মধ্যে হারিয়ে যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। বিভিন্ন দিক থেকে সিঁড়ি কখনও কোনও মন্দিরের মাথায় পৌঁছে দিচ্ছে কখনও চাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আদীশ্বরের মন্দিরটি শিল্পমন্দির বললেও কম বলা হয়। ছবি তোলা নিষেধ শুনেছিলাম। এখানে তীর্থঙ্করদের ও অন্যান্য মূর্তি আছে ১১ হাজার, আর পাদুকা ৯০০টি।
শত্রুঞ্জয় পাহাড়ের দুটি শৃঙ্গ। আমরা হনুমান মন্দির থেকে উত্তর দিকে চললাম। সারা ভারতের জৈনদের কাছে পরম পবিত্র অঞ্চলটি। তৈরি হচ্ছে আরও মন্দির। নাগার্জুনের গুরু পদলিপ্তের নাম অনুসারে পালিতানা। পাহাড়ের মাথায় কোনও যাত্রীকে রাতে থাকতে দেওয়া হয় না।মন্দির গোনা সম্ভব নয়। একই চত্বরে হয়তো ২০০ মন্দির। প্রধানমন্দিরগুলি হল কুমার পাল, ভুলারানি, অষ্টপদ প্রভৃতি।
প্রতিবছর জৈনদের এখানে আসার কারণ যেমন ধর্ম, তেমনি অন্য দিকটা হচ্ছে স্বাস্থ্য। হাওয়া বদলের জন্যও বহু মানুষ মাসের পর মাস ধর্মশালায় কাটিয়ে যান। নীল আকাশের নিচে পাহাড়, চারদিকে জঙ্গল আর নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। নদীর মাঝে মাঝে ছোট ছোট, দ্বীপ, এই দ্বীপে চরে বেড়াচ্ছে ভেড়া। ভেড়াপালকের মাথায় টকটকে লাল রঙের পাগড়ি, হাতে লাঠি। নদীর জলে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয় মন্দিরে, দুধশাদা মন্দির মুক্তোর মতো ঝলমল করে ওঠে। বিকেলে আস্তে আস্তে সূর্য ডুবলে তার লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ে। অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু এ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য সকলের হয় না। কেননা মন্দির চত্বর থেকে সন্ধের আগেই নেমে আসতে হবে। মন্দিরে নটার সময় অঙ্গি উৎসব হয়। সেই সময় আভরণ পরানো হয় দেবতাদের। স্নানের সময় পৌনে এগারোটা। বিফেল তিনটের সময় অলঙ্কারে ভূষিত করা হয় দেবতাদের। এই মন্দিরগুলিতে প্রচুর সম্পত্তি। এমনকী মণি-মুক্তা খচিত সোনার মূর্তিও রয়েছে। সমস্ত সম্পত্তি রয়েছে কল্যাণজী-আনন্দজী মন্দিরের কাছে ট্রাস্টের অফিসে। বিশেষ অনুমতি নিয়ে সেগুলি দেখতে হয়। সেসব রত্নসামগ্রী অবশ্য আমার দেখা হয়নি।
শত্রুদয় পাহাড় থেকে নেমে আসার সময় কাথিয়াবাভের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পটি দেখে নেওয়া যায়। একদম নিচে নেমে আলো থাকতে থাকতে টেম্পল অব মিরর। অর্থাৎ কাচের মন্দির। মন্দিরটি কাচের নয়, মন্দিরের মাথাটি নানা রঙের কাচ দিয়ে মোড়া। হাতে যদি সময় থাকে শত্রুঞ্জয় স্নান করতে পারেন। জৈন শহরে কিন্তু পীরের একটি দরগাও আছে পাহাড়ের মাথায়। বহু মুসলিম মহিলা এখানে আসেন মনস্কামনা পূর্ণ করতে। পালিতানা শহরে আরও একটি দেখার জিনিস আছে। তা হল হীরে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখানে চলে আসে হীরে। কুটির শিল্পের মতো ঘরে ঘরে হীরে কাটার যন্ত্র বসানো হয়েছে, অল্প ঝাসের ছেলেরা একটা গোল চাকায় সারাদিন ধরে হীরে কেটে চলেছে। এদের ঘরে ঢুকে কাজ দেখতে মালিকের অনুমতি নিতে হয়। হীরে হাতে নিয়ে তার ঝলক দেখা বা কেনা কোনওটাই দুষ্কর নয়। একটি ছোট গলির ভেতর প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকার হীরা কেনা-বেচা হয়। না কিনলেও এক সঙ্গে প্রচুর হীরে হাতে নেবার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করাও এক অভিজ্ঞতা।
ছবি : সংগৃহীত ।
সব সময় ই আপনার কাছ থেকে নুতুন তথ্য পেয়ে,নিজেকে অনেক টাই সমৃদ্ধ করতে পারছি।ধন্যবাদ দাদা...
উত্তরমুছুনভালো থাকবেন।
মুছুনDarun ! Ajana tathyo.
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনএকজন ভালো লেখক সর্বদাই নতুন নতুন তথ্য উপহার দিয়ে থাকেন।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই ॥
মুছুনখুব সুন্দর
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকে ।
মুছুনআপনার প্রতিটি ভ্রমণ স্থলের বিবরণ অনাবিল ভাবে সুন্দর এবং তথ্যে পরিপূর্ণ।
উত্তরমুছুনপড়ে আনন্দ পাওয়া যায় এবং একই সঙ্গে ভ্রমণের কিছুটা স্বাদও। অনেক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ আপনাকে ।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা।ভালো থাকবেন।
মুছুনKhub valo
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনDarun darun
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনসকলকে জানাই আমার প্রীতি ও শুভেচ্ছা
উত্তরমুছুন