লোথাল
মৃত নগরী লোথাল
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়
"আমেদাবাদ জেলায় শেষপ্রান্তের একটি প্রত্যন্ত গ্রাম লোথাল। গ্রামের মানুষ এখনও বিশ্বাস করে এটি মৃতদের গ্রাম। গুজরাটি ভাষায় লোথাল মানে মৃত্যু। এই লোথ থেকেই এসেছে লোথাল। চারদিকে বাবলা গাছের জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝে সরু কালো ফিতের মতো রাস্তা গিয়ে মিশেছে মৃতনগরী লোথালে। আমেদাবাদ শহর থেকে ৮০ কি.মি. দূরে।
কাল ৭-১৫ মিনিটে আমেদাবাদ গীতামন্দির বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ছেড়ে পৌনে দশটায় পৌঁছে গেলাম লোথাল। কাছাকাছি মানুষজন নেই। তবে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার পর মানুষ জন আসতে শুরু করেছে এখানে। বাস রাস্তার পাশে একটি ইংরিজিতে বোর্ড লাগানো 'লোথাল যাবার রাস্তা’। মিনিট কয়েক হাঁটার পর চোখে পড়ে খননকার্যের স্থান। ইতিহাস বলে হরপ্পা সভ্যতার আয়তন ছিল ১৩ লক্ষ বর্গ কি.মি.। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্থান, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গড়ে ওঠে এই সভ্যতা। তার মধ্যে ছয়টি নগরের সন্ধান পাওয়া গেছে। মহেন-জো-দরো, হরপ্পা, চানহুদারো, লোথাল, বনওয়ালি, কালিবঙ্গান। প্রথম তিনটি পাকিস্তানে, হরিয়ানায় বনওয়ালি, রাজস্থানে কালিবঙ্গান এবং গুজরাটে লোথাল। এবং গুজরাটের ভূজের কাছেও (ভূজ থেকে ৮১ কি.মি. দূরে) রাপানতে খনন করে সিন্ধু সভ্যতার কিছুই নিদর্শন পাওয়া গেছে। খননকার্যের পর ৬৪টি কাঠের খুঁটি এবং গুদামঘর পাওয়া গেছে। আপাতত খননকার্য বন্ধ।
১৯৫৪ সালে লোথাল আবিষ্কৃত হবার আগেই গ্রামের মানুষ জায়গাটির নাম দিয়েছিলেন লোথাল। প্রথম অবস্থায় ছিল একটি উঁচু ঢিবি। এই ঢিবি থেকে গ্রামের মানুষ পুরনো ইট, মানুষের হাড়, ভাঙা হাঁড়ি-কলসির টুকরো পায়। তারপর প্রত্নতাত্ত্বিকরা শুরু করে খননকার্য। গুজরাটি ভাষায় লোথাল শব্দের অর্থ যেমন মৃত তেমনি সিন্ধি ভাষায় মহেন-জো-দরো শব্দের অর্থও মৃত। খননকার্য শুরু হয় ১৯৫৫ সাল থেকে। চলে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। মহেন-জো-দরো ও হরপ্পার সঙ্গে নতুন করে লেখা হল লোথালের নাম। ১৯৫৫ সালের নভেম্বর মাসে একে একে সব আবিষ্কার হতে লাগল। ৪৫০০ বছর আগের লোথাল শহরণে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। শহরের উচ্চ অংশ বসস্থান থেকে শুরু করে কবরস্থান পর্যন্ত সব কিছুই আবিষ্কার করা হয়েছে। পরিকল্পিত শহরটি ছিল প্রাচীরে বেষ্টিত। সিন্ধু উপত্যকার সমুদ্রতীরের বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বন্দর লোথাল-এর পরিকল্পনা একটু অন্যরকম ছিল। এখানে সমগ্র শহরটি ছিল প্রাচীর বেষ্টিত। বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাড়িগুলি উঁচু মঞ্চের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। শহরের পূর্ব দিকে ছিল জাহাজ মেরামতের স্থান (২১৮ মিটার ×৩৭ মিটার)। খালের সাহায্যে এই স্থানটির সঙ্গে সমুদ্রের যোগসূত্র রচিত হয়েছিল।
হরপ্পার মতো লোথালেও শ্রেণীবৈষম্য ছিল। বিভিন্ন আয়তনের বাড়িগুলি তার প্রমাণ। বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরে ওপরের দিকে বাস করত, শাসকরা। ওপরের স্থানটি সবচেয়ে সুরক্ষিত স্থান যাকে বলা হত অ্যাক্রোপলিস। আবিষ্কৃত হয়েছে ব্যবসাদারদের ব্যবহৃত ছয়টি ঘর। লোথাল শহরটির দৈর্ঘ্য ছিল ১৭৫ কি.মি. ও প্রস্থ ছিল ৪০০ মিটার। লোথালের ভাঙা ঘরবাড়িগুলি দেখলে বোঝা যায় না এটি ৪৫০০ বছর আগের বন্যায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোনও শহরের ঘরবাড়ি। আধুনিক সভ্যতার মতো বড় বড় ইট। প্রত্যেক বাড়িতেই ছিল নিজস্ব স্নানের এবং পয়ঃপ্রণালী ছিল মাটির তলায়। সমুদ্রের কাছের শহরের পোতাশ্রয়টিকে দেখে চিনতে ভুল হয় না। আরবসাগরের মতো নীল জল এখন তাতে টলমল করছে। বন্দরটি ছিল ২১৬ মিটার দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে ৩৭ মিটার। প্রত্নতাত্ত্বিক একটি বোর্ডে লিখে রেখেছেন ৬০ টন ওজনের কমপক্ষে ত্রিশটি জাহাজ একসঙ্গে ডকে আশ্রয় নিতে পারত। বন্দরটিকে আধুনিক কালের বিশাখাপত্তনমের সঙ্গে তুলনা করা চলে। বন্দরটি ইঁট দিয়ে ঘেরা। চারপাশে জলের চিহ্ন না থাকলেও বন্দরে জল প্রচুর। এখানে এখনও সমুদ্রের দেবী ভানুবর্তী সিকোতারি মাতার পুজো হয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন, হরপ্পার বিলুপ্তির পর আরও পাঁচশো বছর পর্যন্ত গুজরাটের সিন্ধু সভ্যতা বজায় ছিল। তারপর আর্য সভ্যতার প্রবল জোয়ারে সে সভ্যতার শেষ চিহ্নও ভেসে যায়। লোথালে বহু জিনিসপত্র আবিষ্কার হয়েছে। তার মধ্যে দুটি টেরাকোটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি অ্যাসিরিয়ান ও অপরটি মিশরের মমি।
লোথালকে ওপর থেকে দেখলে তেমনভাবে উপলব্ধি করা যায় না। আবিষ্কৃত অঞ্চলেই গড়ে উঠেছে প্রদর্শনী কেন্দ্র এবং মিউজিয়াম। প্রথমে যদি কিছু না দেখে মিউজিয়ামে চলে যাওয়া যায় তাহলে লোথালকে উপলব্ধি করা যায়। মিউজিয়ামটি সরকারি ছুটির দিনগুলিতে বন্ধ থাকে। এছাড়া প্রতিদিন দশটার সময় খোলা হয়। বিশাল একটি ছবির সাহায্যে বোঝানো হয়েছে শহরটি কেমন ছিল। বন্দর শহরে কোথা দিয়ে জাহাজ থেকে জিনিসপত্র নামানো-ওঠানো হত থেকে শুরু করে গ্রামের জীবনযাত্রা পর্যন্ত। জিনিসপত্রে ছাপ দেবার জন্য পাওয়া গেছে একটি স্বস্তিক চিহ্নের সীল। মাপার জন্য হাতির দাঁতের স্কেল। তুলাদন্ড। সোনা মাপার জন্য কালো রঙের ছোট্ট ছোট্ট বাটখাড়া।মাটির কুকুর , গরিলা একশৃঙ্গ প্রাণী , পাখি, সাপ ।একশৃঙ্গপ্রাণী, পাখি, সাপ। গহনার মধ্যে দুটি সোনার হার, হেয়ার পিন, কানের দুল, শাঁখের চুড়ি। এই শহরে পুতি তৈরির কারখানাও ছিল, সেটিও আবিষ্কৃত হয়েছে। যে স্থানটিতে পুতি তৈরি হত সে স্থানটি লোহার খাঁচা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এক দম্পতির ফসিলও পাওয়া গেছে। নানা ধরনের ব্লেড পাওয়া যায়, প্রাণীর হাড় দিয়ে পেন, সূঁচ, মাছ ধরার বড়শি, বোতাম, মাটির বড় বড় জালা, ডেকরেশন করা ল্যাম্প শড। দাবার ঘুঁটি রাজা,মন্ত্রী,ঘোড়া, গজ,বোড়ে ইত্যাদি পাওয়া যায়, এক্কা-দোক্কা খেলার ঘুটি, রুটি রাখার শিক এককথায় বলা যায় সভ্যতার সমস্ত নিদর্শনই পাওয়া গেছে লোথালে। মাটির নিচে পাওয়া সমস্ত জিনিস অবশ্য এই মিউজিয়ামে নেই, প্রত্নবস্তুগুলি থেকে বোঝা যায় যে মেসোপটেমিয়া, মিশর এবং পারস্যের সাথে বাণিজ্য পরিচালিত হতে পারে। বাজার এবং ডক সহ একটি সম্পূর্ণ জনপদ এখানে উন্মোচিত হয়েছে। সাইটের কাছাকাছি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর (সকাল 10টা-5টা, শুক্রবার বন্ধ) এখানে গহনা, মৃৎপাত্র, সীলমোহর, ধর্মীয় চিহ্ন এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসের মতো অনেকগুলি প্রত্নবস্তু রয়েছে। । তবে এই লেখায় যে সব জিনিসের নাম করা হয়েছে একমাত্র সোনার হার দুটি বাদে সব জিনিসই দেখতে পাওয়া যায়। লোথালের তিন কি.মি. দূরে বয়ে যাচ্ছে ভোগা নদী।
ছবি : সংগৃহীত ও সমীর ।
অসাধারণ লিখেছেন ।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনNice very nice
উত্তরমুছুনতথ্যপূর্ণ লেখা পড়ে জ্ঞানসমৃদ্ধ হোলাম।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা
মুছুনধন্যবাদ 💐🙏👍
উত্তরমুছুনআপনি আমার শুভেচ্ছা গ্রহন করুন
মুছুনবাহ ! বেশ তথ্যসমৃদ্ধ লেখা | ভালো লাগলো |
উত্তরমুছুনএককথায় অনবদ্য লেখা,কথা হবে না....
উত্তরমুছুনধন্যবাদ দিদি
মুছুনআমি এখানে গিয়েছি।জায়েগাটি খুব ভালো লেগেছে। ইতিহাসকে যারা ভালোবাসে তাদের পক্ষে উপযুক্ত জায়গা। তথ্য বহুল লেখাটি পড়ে আমার খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা
মুছুনখুব সুন্দর লেখা। ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনধন্যবাদ নেবেন
মুছুনSundar দৃশ্য pot উন্মোচিত করেছেন, khub bhalo laglo l
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনখুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনজ্ঞানার্জন করলাম
উত্তরমুছুনধন্যবাদ ।
মুছুনVery nice
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনOSADHARAN lekha photography. Itihas katha bole apnar lekha pore r ekbar upolobdhhi korlam. Ami apnar lekhar bhakto hoye giyechhi. Poroborti lekhar opekshay roilam. Bhalo thakben. Dhonnyobad apnake lekhatar jonnyo.
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ।
মুছুনDarun picture drun lekha
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুন