দিউ
দিউ
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়।
সোমনাথ থেকে বেড়িয়ে দিউ এর দিকে যাচ্ছি। আমার এক সহযাত্রী গাড়ির জানালা দিয়ে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন ওই দেখুন পাঁচ মাথা তাল গাছ। আমি ওনাকে কিছুতেই বোঝতে পারছি না ওটা তাল গাছ নয়। এই গাছ গুলো তাল গাছের মতো দেখতে হলেও এদের নাম হোকা। এই ধরনের গাছ আফ্রিকা থেকে এসেছে । পর্তুগিজরা এই গাছ এখানে লাগিয়েছিলেন । পরে ভুল ভাঙল দিউ এসে।
পাঁচ মাথা গাছ |
সমুদ্রে ঘেরা ছোট্ট একটি দ্বীপ দিউ। গুজরাট থেকে একে আলাদা করে চিহ্নিত করা খুবই মুশকিল। গুজরাটের মানচিত্রের নিচে এর অবস্থান। দিউ নামটি একা উচ্চারণ হয় না সঙ্গে যুক্ত হয় গোয়া-দমন। গোয়া যেমন পর্যটকদের কাছে খুবই চেনা নাম দিউ ততটাই অপরিচিত। গোয়া এবং দিউ-র পার্থক্য খুবই সামান্য। পার্থক্য অবস্থানের আর আয়তনের ৷ দিউ-র সী বিচে গোয়ার মতো মানুষ নেই, তবে রঙিন হয়ে আছে নাগোয়া বিচ । স্পিডবোর্ড চলছে । ওয়াটার স্কুটার চলছে । থাইল্যান্ডের ফুকেট এর মত সমুদ্রের মাঝে অস্থায়ী জেটি বানিয়ে প্যারাসুট রাইডিং করাচ্ছে । শান্ত সী বিচে রয়েছে এক অনাবিল আনন্দ। প্রকৃতি একে নিজের মতো সাজিয়ে তুলেছেন। একদিকে নীল-শাদা সমুদ্রের জল আছড়ে পড়ছে পশ্চিমে, পূর্বদিকে সমুদ্র যেন কিছুই জানে না, শান্ত ভালো মানুষটির মতো গুটি গুটি নিস্তরঙ্গভাবে এগিয়ে চলেছে। একদম বিপরীত চরিত্র। আরবসাগরের ছোট্ট দ্বীপের পাশ দিয়ে চলেছে বড় বড় জাহাজ।সমুদ্রকে উপভোগ করতে গেলে চাই নির্জনতা। দিউ হল ঠিক তার উপযুক্ত স্থান। নাগোয়া বিচ ছাড়া দিউ এর অন্য বিচ গুলো তেমন সাজান নয়। পর্যটনটরা ভিড় করেন নাগোয়া বিচে ।
নাগোয়া বিচ |
আমেদাবাদ থেকে ভোরে দিউ যাবার সরাসরি বাস আছে। ভাবনগর, পালিতানা, সোমনাথ, ভেরাবল থেকে বাস আসছে । সোমনাথ থেকে দিউ যাবার একটা রেওয়াজ আছে। একইদিনে দিউ ঘুরে ফিরে আসেন ভ্রমণকারীরা। দিউ সব মিলিয়ে মাত্র ২১ কি.মি. অঞ্চল, কিন্তু একদিনে দিউ ঘোরা সম্ভব হলেও, দিউকে বুঝতে গেলে কমপক্ষে চারদিন থাকা দরকার।
প্যারা সুট রাইড |
একসময় পর্তুগিজদের শহর ছিল গোয়া-দমন-দিউ। ভারতের স্বাধীনতার ৮ বছর পর এই তিন দ্বীপের মানুষেরা চাইল ভারতের মানচিত্রের সাথে অঙ্গীভূত হতে । তারপর আরো কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৯ তারিখে তিন দ্বীপ পর্তুগিজ শাসনের হাত থেকে মুক্ত হয় । স্বাধীন হওয়ার পর দ্বীপের অধিবাসীরা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য কোন রাজ্যের সাথে যুক্ত হলো না ।
দিউ দুর্গ |
আলাদা রাজ্য হিসাবে স্বীকৃতি পেলেও দমন এবং দিউ রয়ে গেল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে। যদিও দমন থেকে দিউ-র দূরত্ব বহু তবুও পর্যটনদপ্তর দুটি দ্বীপকে একইসঙ্গে পরিচালনা করেন। দিউ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দ্বীপ থেকেই। দিউ-র আরেক নাম সঙ্কলকোট। একসময় সৌরাষ্ট্রের সমুদ্রতটের সঙ্গে দিউয়ের নিয়মিত জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রিত হত লোহার শিকল দিয়ে। সেই থেকেই এসেছে সঙ্কলকোট। ষোড়শ শতাব্দীতে দিউ-র পরিচিতি ঘটে নৌবাহিনীর সুরক্ষিত পোতাশ্রয় এবং সর্বোৎকৃষ্ট বেলাভূমি হিসাবে। এই দ্বীপে এসেছিলেন ভাস্কো-দা-গামা, অলমিদা, আলবুকার্স ইত্যাদি অভিযানকারী। দিউয়ের আয়তন ৩৮.৮ বর্গ কি.মি.। লোকসংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। বাৎসরিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭০ সেমি। দিউতে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি, প্রতি ১০০০ পুরুষে নারী ১১৩৯ জন।
দুর্গের ভেতর |
দিউকে দেখতে হবে দুরকম সময়ে। একবার দিনের আলোয়, একবার রাতের আলোয়। দিনেরবেলা দেখতে হবে দিউয়ের দুর্গ। স্থানীয় মানুষ পুরনো দুর্গও বলে থাকেন। ১৫৩৫ সাল থেকে ১৫৪১ সালে তৈরি। গুজরাটের সুলতান এবং পর্তুগিজরা এক হয়ে এই দুর্গ থেকে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। দুর্গের তিনদিকে নীল সমুদ্র আর একদিকে খাল। ১৯৬১ সালে অপারেশন বিজয়ের সময় পর্তুগিজরা এখান থেকে যুদ্ধ করেছিল। দুর্গের চারদিকে কামান এবং গোলা। বিশাল দুর্গের মাথায় পৌঁছে যাওয়া যায়। পাথরের দুর্গের স্থাপত্য দেখার মতো। দুর্গ থেকে অসাধারণ লাগে দীঘার সমুদ্র । দুর্গের মাথায় রয়েছে বেশ কয়েকটি কামান । দুর্গের একটু দূরে রয়েছে লাইট হাউস। এই লাইট হাউসটির কাজ ছিল একটু অন্যরকম। শীতকালের রাতে কুয়াশায় ভরে যেত চারদিক। ধোঁয়ার ভেতর দেখা যায় না ফোর্টকে। কুয়াশা মুক্ত করার জন্য লাইট হাউস থেকে একরকম গ্যাস ছড়িয়ে দিয়ে দুর্গকে কুয়াশা মুক্ত করা হত। দুর্গে ঢোকার আগে একটি দুর্গ রয়েছে সমুদ্রের মধ্যে নাম পানিকোঠা দুর্গ। পানিকোঠাকে বলা হয় লাইট হাউস।
পানিকোঠা |
রাতেরবেলা পানিকোঠা দুর্গকে সুন্দর লাগে। এখান থেকে ঘুরে নিতে হবে নাগেশ্বর মন্দির। সমুদ্রের জল এসে শিবলিঙ্গের মাথায় আছড়ে পড়ছে। দিউ বিচ থেকে তিন কি.মি দূরে ফুদাম গ্রামে। শহরের মধ্যে নয় লক্ষ বা ন-লাখ শিবনাথ মন্দিরটি। বাজারের মধ্যে জামা মসজিদ। ৮৪টি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদে প্রায় ৫০০ মানুষ একইসঙ্গে নমাজ পড়তে পারেন। ঘোরা যায় ঘোঘলা বিচ, জলন্ধর বিচ। তবে জলন্ধর বিচে স্নান করা যায় না। দিউয়ের গোমতীমাতা বিচটি নাগোয়া বিচের কাছাকাছি, সুন্দরের দিক থেকে। শহরের পশ্চিম কোণে শাদা বালিতে ঘেরা বিচটিতে যাবার রাস্তা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। থাকার জায়গা এখনও তৈরি হয়নি। পর্যটন বিভাগ হোটেল তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছে, হোটেল হয়ে গেলে নাগোয়া বিচের আকর্ষণ অনেক কমে যাবে। চক্রতীর্থ বিচটিও কয়েক বছরের মধ্যে সেজে উঠবে। সমুদ্রের পাশে ছোট ছোট টিলা, এরইমধ্যে বিচ। গড়ে উঠছে মিনিডিজনিল্যান্ড।
চার্চ |
দিউ ঘুরতে-ঘুরতে সবসময় নাকে আসে মাছের গন্ধ। এখানে মৎস্যজীবী মানুষের সংখ্যা বেশি। লবণ এবং মদ উৎপাদন হয়। গুজরাটে যেমন মদ নিষিদ্ধ, তেমনি দিউতে চায়ের দোকানের চেয়ে মদের দোকান বেশি।
দিউ থেকে মদ কিনে গুজরাটে প্রবেশ নিষেধ। দিউ এবং গুজরাটের বর্ডারে পুলিশ সদাসতর্ক। দিউতে রয়েছে তিনটি গির্জা। গির্জা দেখার উপযুক্ত সময় রাত্রে। পূর্তবিভাগের বিশ্রামগৃহের পাশে ৩০৪ বছরের পুরনো সেন্ট পলস গির্জা। আরবসাগরের ফেনার মতো শাদা গির্জাটিকে আলো দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অপরূপ স্থাপত্য শিল্প। গির্জার ভেতরে কাঠের কাজগুলি দেখার মতো। সুউচ্চ গির্জার পাশেই সেন্ট ফ্রান্সিস গির্জা এবং মিউজিয়াম। জলের ফোয়ারা দিয়ে এবং তার সঙ্গে আলো দিয়ে গির্জাটি এমন সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে যে দূর থেকে মনে হয় সমুদ্রের ভেতরে রয়েছে গির্জাটি। এই গির্জাটির সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে দুর্গে পৌঁছে যাওয়া যায়। আওয়ার লেডি অব মার্সি এবং আওয়ার লেডি অব রেমিডিওস গির্জা।
নাগেশ্বর মন্দিরে পথ |
রাতের দিউ দিনের আলোর থেকেও ঝকঝকে। চারদিকে দোকান আর রেস্টুরেন্ট-কাম-বার। আরবসাগরের ধারে ছাতার তলায় যে যার মতো অবসরযাপন করছেন। রাস্তার ধারে সমুদ্রের জল এসে ধাক্কা মারছে। দিউ বন্দরের কাছেই রয়েছে মউজিক চ্যানেল ছোট্ট পার্ক। পার্কের মধ্যে কুড়ি ফুটের একটি চাতাল করে বসানো হয়েছে মিউজিক চ্যানেল। চাতালের চারপাশে জল বের হচ্ছে ফোয়ারার মধ্য দিয়ে। ফোয়ারার পাশ থেকে উঠে আসছে গানের সুর। প্রতিদিন সন্ধেবেলা এখানে ভিড় হয়। কয়েকপা গেলেই রয়েছে অ্যাকোয়ারিয়াম পার্ক। এখান থেকে ঘুরে দেখে নেওয়া যায় মারওয়ার স্মৃতিস্তম্ভ। দিউয়ের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতিতে গড়া শহিদ বেদি।
যেমন সুন্দর লেখা তেমনি সুন্দর ছবি
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুনDaun sunder lekhe . Bhlo laglo
উত্তরমুছুনআপনার লেখা খুব ভালো লাগলো, ছবিগুলো সুন্দর।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক শুভেচ্ছা নেবেন।
মুছুনNice writing ...keep it up...Sir
মুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনKhub bhalo.Waiting for such more writings
উত্তরমুছুনঅনেক শুভেচ্ছা অনেক স্নেহ রইলো ।
মুছুনSundar lekha r songer chhobigulio jogyo sangat korechge.
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনঅপূর্ব ! প্রানবন্ত লেখনী ।
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনখুব সুন্দর। খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকে।
মুছুনAbar mona pora galo purono dinar kotha, Sai jail Sai bich Sai dim siddo kahoa .
উত্তরমুছুনKhub sundor lagchilo purota porta.
Thanks 👍👍👍
আপনি আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন
মুছুনOpurbo sundor jaiga. Apnar lekhanite je tathya r barnona pore mugdha hoye giyechhi.
উত্তরমুছুনআপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
মুছুনদারুন সুন্দর লেখা✏️
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকে
মুছুনবেশ ভালো লেখা
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুনখুব খুব খুব সুন্দর লাগলো। 🙏🙏🙏
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মুছুনসাবলীল লেখনী বহুকাল ধরেই অধিগত।তারই অসাধারণ প্রকাশ! তোর এই লেখাগুলো সব মিলিয়ে চমৎকার হচ্ছে! খুব আনন্দ পাই এই ভেবে যে তুই আবার কলম হাতে তুলে নিয়েছিস! সপরিবার ভালো থাকিস।
উত্তরমুছুনঅনেক শুভেচ্ছা ।হ্যাঁ আমরা ভালো আছি। তোরাও ভালো থাকিস।
মুছুনবেশ লিখেছেন, দিউ ভ্রমণ পর্বে আপনার ভ্রমণ সাথী ছিলাম।মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি আপনার বর্ণনা।চোখের সামনে ভাসছে নাগোয়া বিচ, দিউ দুর্গ, হোকা গাছ,পানি ঘর আর মনে থাকবে দিনের বেলার সমুদ্রের পাশে সূর্যের তপ্ত বিচ্ছুরণ। পড়ন্ত বিকেলে বিচের ধারে চা খাওয়া সাথে ভ্রমন পিপাসুদের ওয়াটার স্কুটার,স্কুবা ড্রাইভিং দেখার অসামান্য অভিজ্ঞতা।
উত্তরমুছুনভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ
মুছুন