ওড়নি

 লেক সিটির ওড়নি 

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়।

উস্রি নদীর ঝর্না দেখতে যাব। দিনটা বড়ো বিশ্রী। আমি দিনটাকে একদম বিশ্রী বলতে পারছি না তবে খুব যে সুশ্রী সেটাও বলবো না । কুয়াশার পাতলা কম্বল ঢেকে রেখেচে  চারিদিক । ২০২২ জানুয়ারী মাস  কনকনে শীত তবে দস্তানার প্রয়োজন নেই । দিগন্তে  হালকা হালকা পাহাড়ের রেখা নাকি মনের ভুল , ঠিকমত বুঝতে পারছি না । গাড়ির কাঁচ বন্ধ । আমার সাথে চলছে পাতলা  মেঘেরা । আমায় সবাই বলেছিল ওড়নি দেখতে যাব। আমি শুনেছি উস্রি নদী  দেখতে যাব। আর ভাববো নাই বা কেন? উস্রি নদীর থেকে খুব দূরে তো নেই! এদিকে বিহারের বাঁকা আর ওপাশে ঝাড়খণ্ডের গিরিডি। আবার কান পাতি। বলি আরেক বার বলো তো কি নাম জায়গাটার ? ও বুঝেছি ওড়নি। মানে চাদর । চাদরের বাঁধ দেখতে যাব। বাঁধ দেখার জন্য এতো দূর? ভাই দেবজ্যোতি কি দেখব বাঁধ? সুন্দরবনে অনেক বাঁধ দেখছি এখানে কিন্তু তোমরা আমায় জোর করেই নিয়ে চলেচ। কেউ জানে না সেটা কেমন বাঁধ! চলো মন  রূপ নিকেতনে। রসিক চলে রসের  খোজে। আমরা চলি বাঁধের খোজে। 


 মেঘ কুয়াশার মাঝে রাস্তার দু'পাশে হলুদের রেখা । সরষে বাগান গুলো মাঝে মাঝে পরিষ্কার হয়ে আবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে । সকাল সকাল যাবার কথা ছিল । তা আর হয়ে উঠেনি । একটু দেরি করেই বেড়িয়েচি তবুও কুয়াশার হাতছানি । ভাগলপুর থেকে রেল ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি চলেছে বাঁকার দিকে । বিহারের বাঁকা একটি জেলা ।বাঁকার মধ্যে এই সাব ডিভিশনে, অমরপুর, শম্ভুগঞ্জ, বেলহার, ফুলিদুমার, কাটোরিয়া, চন্দন, বংশী  এই সব গুলোকে জেলাকে নিয়ে বলা হয় সিটি অফ লেক। আমি চানান,বিলাসী, বেলহারম দুর্গাবতী বাঁধের নাম শুনেছিলাম কিন্তু  ওড়নি বাঁধ বা লেকের নাম শুনিনি। আমাদের বাঁধ দেখতে যেতে হবে সেই বাঁকা জেলার লোধম গ্রামে । বাঁকা দেওঘরের প্রায় মাঝে।  সেখানে তৈরি হয়েছে নতুন একটি লেক । 


বড় সড়ক ছেড়ে আমরা ডান দিকে ঘুরে গেলাম । যেতে হবে আরো ১২ কি মি.সেখান থেকে শুরু হল লাল মাটির রাস্তা । ভাগলপুর থেকে মোট ৬৫ কি মি। আমাদের গাড়ি সরাসরি পৌঁছে দিল ওড়নি লেকে। 

 আমরা পৌঁছতে এই টুরিস্ট দলকে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন ওড়নি লেকের মানুষজন । এও এক নতুন পাওনা । বিহারের বাঁকা পর্যটনের কেউ নাম জানে না। কয়েক মাস আগে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নিতিশ কুমার দুটো সুন্দর কাজ করেছেন । একটি এই ওড়নি লেককে পর্যটন মানচিত্রে এনেছেন । আরেকটি মন্দার পাহাড়ে  রোপওয়ে চালু করেছেন । বিহার সরকার যে পর্যটন নিয়ে ভাবছেন এটা কার সবচেয়ে বড় উদাহরণ । ভাগলপুরকে পর্যটন মানচিত্রে আনার জন্য হিমালয় ট্যুরিজমের সাথে হাত মিলিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ভাগলপুরের অধ্যাপক দেবজ্যোতি  মুখোপাধ্যায় ,ইশস্তেহাক রেজা ও তার সহযোগীরা । 


দূরে যে পাহাড় গুলো দেখা যাচ্ছিল তার চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল । এ যেনো কাশ্মীরের ডাল লেক এসেছি  দু পাশে পাহাড় তারই  মাঝে টলটলে জলে লেক ভাসছে।যতদূর দেখা যায় শুধু জল আর জল । এই জলের স্রোত নেই আছে ঢেউ । একি দেখছি বিহারে বসে ওয়াটার স্কুটার ! বিস্ময় চোখ ভরে যায় । রাবারের টান টান চাদর যেনো বিছিয়ে রাখা হয়েছে লেকের মাঝে । মাঝে মাঝে  গজিয়ে উঠেছে অসাধারণ কিছু ছোট ছোট দ্বীপ । আমরা ঐ দিকেই যাব । ওটা কি সবুজ দ্বীপ ? ঘন কুয়াশায়  চোখে দ্বীপের রেখা ভেসে উঠছে । আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে আয় । আমরাও স্পিড বোটে উঠে পড়ি । অনন্ত জলরাশির মাঝে নিজেদের বড় ক্ষুদ্র মনে হয় । প্রায় ১৫ মিনিটে দুরন্ত গতিতে স্পিডবোর্ড আমাদের পৌঁছে দিলো সেই অজানা দ্বীপের মাঝে। দ্বীপের মাটিতে পা দিয়ে মনে হল এ কোথায় এলাম ? চারিপাশে জল ছাড়া তো আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না । এখানে কি আমরা হারিয়ে যাব ? যে যার মত একা একা ঘুরতে শুরু করে ।


দ্বীপের মাঝে কোন জন্তু জানোয়ার নেই । কিন্তু সুন্দর সুন্দর পাখির ডাক কানে আসে । অনেক পাখিও দেখা মেলে । কয়েকটি পরিযায়ী পাখি ও দেখলাম । আমরা ছাড়া কোনো মানুষ নেই এই দ্বীপে । সভ্যতার চকলেটের কাগজ, সভ্যতার ঠান্ডা পানীয়র কোন বোতল বা ক্যান এখানে চোখে পড়েনি । একদম ভার্জিন দ্বীপ । শুনলাম এই দ্বীপে তৈরি হবে থাকার জায়গা । তার প্রস্তুতিও চলছে । 

কোথা থেকে এলো এই জল ? কোথায় নদী ? কি বা তার নাম এই নদীর? একটি নদীর নাম ওড়নি অন্যটি ভরনি। যেনো দুই বোন একসাথে মিলেমিশে খেলা করছে!  ভরনি ছোট সে মাত্র ১২ কি মি এ



সে মিশে গেছে দিদির সাথে। চারপাশে রয়েছে ৬ টি পাহাড়। ৮.৩ বর্গ কিলোমিটার লেকের   জল এসে জমা হচ্ছে নদী ও পাহাড় থেকে।  সারা বছর এই জলকে সেচের কাজে ব্যবহার করে কৃষির অগ্রগতি হচ্ছে । ৬ টি পাহাড় এক যোগসূত্র গাঁথা । কেউ যদি ট্রেক করেন তার মাঝে থাকবে প্রকৃতির অনাবিল আনন্দ । বাঁকা পর্যটন দপ্তর এই পাহাড়ের মাঝে মাঝে কয়েকটা হাট তৈরি করবেন থাকার জন্য।  একথা জানিয়েছেন ওড়নি লেকের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক রাজেশ ভাই । ওয়াটার স্পোর্টস এর জন্য যে কটি স্পিডবোট ও স্কুটার আনা হয়েছে সবই কেনা মুম্বাই থেকে আর শিক্ষণ প্রাপ্ত চালক  সবই উত্তরাখন্ডের  টিহেরি জেলার মানুষ । 

বাঁকা জেলাকে বলা হয় লেকের শহর । সব মিলিয়ে ১১ টি লেক আছে  ৫ টি বড় আর ৬ টি ছোট। তার মধ্যে চানান লেককে ও ইকো ট্যুরিজম করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা চলছে। 

আমরা এসেছি দূপুরে। লেক ঘুরতে বিকেল হয়ে গেল উপরি পাওনা হিসেবে পেলাম লেকের উপর অসাধারণ সূর্যাস্ত ।


কেমন ভাবে যাব? ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রেল যোগাযোগ রয়েছে ভাগলপুরের। ভাগলপুর স্টেশনে নেমে হোটেলে চলে আসুন। বিভিন্ন মাপের হোটেল আছে তবে অন্যান্য পর্যটনস্থল এর থেকে এখানে হোটেল ও গাড়ির দাম একটু বেশি । প্রচুর হোটেল আছে।  


পরের দিন একটা গাড়ি নিয়ে চলে আসুন। তবে বাঁকাতেও বেশ কিছু হোটেল আছে। সেখানেও থাকতে পারেন। তবে আমি বলছি ভাগলপুরে থাকাই ভালো।

মন্তব্যসমূহ

  1. খুব সুন্দর লেখা।জায়গাটা ও দারুণ।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন. ভালো লাগলো.

    উত্তরমুছুন
  3. দারুন একটা জায়গার সন্ধান পেলাম।

    উত্তরমুছুন
  4. আশি র দশক এ আমার দেখা উস্রি ঝরনা র স্মৃতি ফিরে পেলাম, খুব ভালো লাগলো আপনার বর্ণনা। বাঁকা তে যাবার ইচ্ছা রইলো।

    উত্তরমুছুন
  5. খুব ভালো লেখা বামাদা। ছবির মতো দেখতে পেলাম সব।

    উত্তরমুছুন
  6. অসাধারণ ‌লেখা। আপনার লেখা পড়ে ‌‌অনেককিছু জানতে পারলাম।

    উত্তরমুছুন
  7. অনেক নতুন নতুন তথ্য জানতে পারলাম। খুব ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন
  8. খুব ভালো লিখেছেন, আপনি সব সময়ই খুব ভালো লেখেন।

    উত্তরমুছুন
  9. আপনার বর্ণনায় মুগ্ধ হলাম ওড়নি দেখার ইচ্ছেটা এবার আরো বেড়ে গেল

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।শুভেচ্ছা নেবেন ।

      মুছুন
  10. দারুন লেখাটা। একদম নতুন। ভ্রমণে পড়েছি। তবে এই লেখাটা বেশি ভালো।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম