রাণী কী ভাভ

রাণী কী ভাভ

বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায় 

"জনহীন প্রান্তরে প্রাকার ঘেরা দেবদেউল। মন্দিরের গায়ে মসৃণ স্তম্ভের আশেপাশে দিনের আলো, চাঁদের সুষমা মেখে দাঁড়িয়ে আছে তারা। দেবতা আছেন মন্দিরে, মন্দিরের বাইরে যৌবন সৌন্দর্যের অনন্ত সম্ভার। সুঠাম তনুদেহে লাবণ্যের জোয়ার। পীনোন্নত বক্ষে স্বচ্ছ উত্তরীয় হয়ত আছে, দেখা যায় না। প্রলম্বিত মুক্তোর মালাটি স্তন স্পর্শ করে লুটিয়ে পড়েছে সুগভীর নাভির ওপরে। বলয়-কাঁকন শোভিত মৃণাল বাহুদুটি দু কেউ রেখেছে সুবিন্যস্তভাবে, কেউ মালার মতো জড়িয়ে ধরতে চায় প্রিয়তমকে, কারোর হাতে দর্পণ কারোর হাতে পাখি, কারো বা করাঙ্গুলে ব্যঞ্জনাময় মুদ্রা। ক্ষীণ কটির তটে কারুকার্য করা চন্দ্রহার। নীবির বাঁধন শিথিল হয়ে গুরু শ্রোণীদেশ ঘিরে অধোবাস নেমে এসেছে নিটোল উরুর সীমা ছাড়িয়ে অচঞ্চল চরণপ্রান্তে। স্থির হলেও তাদের পায়ের নৃত্যের ভঙ্গি বিভ্রম ঘটাতে চায় । এখনি বুঝি ছন্দে তালে বেজে উঠবে নূপুর, অঙ্গে ফুটে উঠবে নতুন ভঙ্গি। সূক্ষ্ম বস্ত্রের ভাঁজেভাঁজে ফুটে উঠবে ইঙ্গিতময় দুটি চারটি রেখা । শুধু কি ঐ ভঙ্গিটুকু ? কাছে গেলেই চোখে পড়ে অপরূপ ছাদের কমনীয় মুখে যৌবনশ্রী । "

 প্রতিটি স্টেপে রইছে এরকম পিলার

আজ থেকে ৩০  বছর আগে চিত্রা দেব ভারত ভাস্কর্যে নারীর যৌবন সৌন্দর্য নামে  দেশ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে  লিখেছিলেন।  তাতেই ছিল এই কথা গুলো। 

কিছুক্ষণ আগে আমি দেখে এসেছি মধেরার সূর্য মন্দিরের  অসাধারণ ভাস্কর্য । পার্বতীর বড় বড় ভাস্কর্য দেখে আমি মুগ্ধ  হয়েছিলাম । যৌবনের সৌন্দর্য যে কতো চিত্রিত কতো বর্ণময়  সেই সব অসাধারন ভাস্কর্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ভাবি সেই সব শিল্পীদের কথা । যারা কোনদিন অপ্সরাকে  দেখিনি, মডেল কি জিনিস তা জানতো না । দরিদ্রের অন্ধকারে স্ত্রীকেও ফেলে চলে আসতে হয়েছে অনেক দূরের দেশে । তারা জানলো কি করে নারীর শরীরের বিভঙ্গ কে ? নিখুঁত ছিল তাদের কল্পনা ।  

 সেই বিখ্যাত কুয়ো 

সেসব মাথায় নিয়েই  এসেছি রানি কি ভাভ দেখার জন্য । কোথায় কি?  সবুজ গালিচা পাতা একটা বড় পার্কের মধ্যে প্রবেশ করি । তাও আবার ৪০ টাকার  টিকিট  কেটে ! চারিদিকে সবুজ প্রান্তর । মাঝে মাঝে দু একটা গাছের ছায়া । কি অবলীলাক্রমে খেলে বেড়াচ্ছে কাঠবিড়ালিরা। বেলা তখন কত হবে খুব বেশি হলে তিনটে । সবুজ লনে পা ডুবিয়ে  দি । বিক্ষিপ্তভাবে মানুষজনকে আমি দেখতে পাচ্ছি । কিন্তু রানি কি ভাভ সেটা আমি দেখতে পাচ্ছি না । একজন গাইড এসে আমাকে বললেন চলুন আপনাদের আমি গাইড করে দেবো । কি দেখতে এসছি আর কেমন ভাবে দেখব এটাকে আগে পরিষ্কার করে নেয়া ভালো । দেখতে এসেছি একটি কুয়ো বা ইদারা কি । যেটা প্রায় ২১৪ফুট  লম্বা, ৬৬ ফুট চওড়া এবং  ৯২ ফুট গভীর। ইদারা কে দেখতে গেলে  স্টেপওয়েলটি সিঁড়ির সাতটি স্তরে বিভক্ত । 

 সারা জায়গায় দেয়ালে এরকমই সব কাজ 

কে করে ছিলেন? এখানে একটা মজা আছে । সমস্ত রাজারাই রানীর মৃত্যুর পর একটা স্মৃতিসৌধ তৈরি করে যান। রানীর প্রতি ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে । এখানে রাজার মৃত্যুর পর রানী তৈরি করেছিলেন রাজার স্মৃতি ।  ১০৬৩ খৃষ্টাব্দে রাজা  ভীমদেবের স্মৃতিতে এই কূপটি খনন করান রানি উদয়ামতী।কিন্তু দুঃখের বিষয় শেষ পর্যন্ত উদয়মতি পূর্ণাঙ্গ রানি কি ভাব দেখে যেতে পারেননি । গুজরাট , মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বরাবরই জলের অভাব । এই জলের অভাব মেটানোর জন্য মেয়েরাই দূর-দূরান্ত থেকে মাথায় করে জল নিয়ে আসে । জলের অভাব কে দূর করতে এবং মেয়েদের নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দিতেই উদয়মতির মনে আসে এরকম ইদারা তৈরি করার কথা । যেখানে মেয়েরা সারা বছর জল পাবে জল আসবে সরস্বতী নদীর থেকে । নিরাপত্তা টা কেমন ? সমস্ত দেয়াল জুড়ে দেব দেবীদের মূর্তি স্থাপন করে দাও । এতে পাপ কর্ম কম হবে । 

 ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছে 

ইঁদারার গায়ে পাথরে খোদাই করা সুন্দর সব কারুকার্য রয়েছে। ৩০ মিটার গভীর এই কূপের অসাধারণ সব কারুকাজ সোলাঙ্কি রাজত্বের আমলে স্থাপত্যের নমুনা আজও তুলে ধরে। কূপের গায়ে চারপাশে ৮০০টিরও বেশি ছবি খোদাই করা আছে। এর বেশিরভাগই বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে খোদিত। বিষ্ণুর দশ অবতার ছাড়াও  বুদ্ধের ছবি আমি দেখেছি । ৫০০ র বেশি মূল বড় মৌলিক ভাস্কর্য প্যানেল ও ১০০০ এর বেশি মিনিয়েচার ভাস্কর্য।  প্যানেল ছাড়াও থাম , সিলিং, জাফরি দেওয়ালে ধর্মীয় মোটিফে ভারতীয় ধর্মীয় মাইথোলজির বিকাশ ঘটেছে । সরস্বতী নদীর জলে দীর্ঘদিন এই ইঁদারা ডুবে থাকার পর  ১৯৮০-র শেষের দিকে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া একে উদ্ধার করে।২০১৪ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের ও ২০১৬ ভারতের শ্রেষ্ঠ পরিচ্ছন্নতা পুরস্কার পায় এই সৌন্দর্য স্থাপত্য স্থল। 

 যা কাছে গেলেই চোখে পড়ে অপরূপ ছাঁদের কমনীয় মুখে যৌবনশ্রী। পাষাণীর রূপ পেয়েছে মানুষের আকাঙ্ক্ষা । এরা তো বিধাতার সৃষ্টি নয়। মানুষের ছেনি আর হাতুড়ি পাথরের অঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছে নারী দেহের দৈবী লাবণ্য। সে সময় যে মেয়েরা বাড়িতে স্যান্ডেল পড়তো বা এক হাজার  বছর আগে মেয়েরা মুখে লিপস্টিক দিত সে মূর্তি ও চোখে পড়ে এইসব ভাস্কর্যে । 

 ফলকে লেখা


কাছে গেলেই চোখে পড়ে অপরূপ কমনীয় মুখে যৌবনশ্রী। মরাল গ্রীবার ভেঙে পড়ছে অন্ধকার বিদিশার নিশার একরাশ ঘন চুলের খোঁপা। খোলা চুলে একটা গুচ্ছ নেমে এসেছে শুধু কপালে অনাবৃত কাঁধেও । বিশাল ধনুকের মতো দূরেখা, তিল ফুলের মতো টিকলো নাকের দুটি আয়ত নয়নে মদবিহ্বল দৃষ্টি । স্ফুরিত  নিঃশব্দ আহ্বান। কবে থেকে পাষাণীর রূপ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ?  নারীদের দৈনন্দিন জীবন ও ক্রিয়াকলাপে চিত্রিত করা বিশাল সংখ্যক ভাস্কর্য রয়েছে। একটি ভাস্কর্যে একজন মহিলাকে তার চুল আঁচড়ানো, তার কানের দুল সামঞ্জস্য করা এবং আয়নায় নিজেকে তাকাচ্ছেন। আরেকটি ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে একজন নারী চিঠি লিখছেন, এক তরুণী একজন বামন পুরুষের দাড়ি টেনে নিচ্ছেন, একজন মহিলা তার হাতে মাছের প্লেট নিয়ে একটি সাপ ঘিরে রেখেছে। তার পা এবং মাছের কাছে পৌঁছেছে। একটি ভাস্কর্যটিতে একটি যুবতী মহিলা তার ভেজা চুল নিয়ে স্নান থেকে বেরিয়ে আসা এবং একটি রাজহাঁস তার চুল থেকে ঝরে পড়া জলের ফোঁটাগুলিকে মুক্তোর মতো করে ধরতে দেখানো হয়েছে। এই মহিলাদের ভাস্কর্যগুলি চুড়ি, কানের দুল, নেকলেস,  পায়ের পাতা এবং অন্যান্য গহনাগুলির পাশাপাশি মার্জিত জামাকাপড় এবং ভালভাবে আঁচড়ানো চুলে শোভা পায়। বিভিন্ন অভিব্যক্তি এবং আবেগ তাদের মধ্যে চিত্রিত করা হয়. তারা সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রেমকে এর মহৎ এবং প্রলোভনসঙ্কুল আকারে ইরোটিকিজমের সংকেত দেয়। এখানে মাতৃ প্রেমের প্রতিনিধিত্বকারী ভাস্কর্য রয়েছে যেমন একজন মহিলা তার সন্তানকে ধরে রেখেছেন এবং তার মনোযোগ সরানোর জন্য চাঁদের দিকে ইশারা করছেন, একজন মহিলা তার সন্তানকে উঁচু করে তুলেছেন যাতে তাকে গাছ থেকে একটি আম তুলতে দেওয়া হয়, একটি আমের বাগানে একজন মহিলা তার সাথে বাচ্চাদের নিয়ে ভ্রমণ করছেন। কতো ভাস্কর্যের কথা বলব । মোটামুটি সব ভাস্কর্য দেখতে তিন দিন সময় লেগে যাবে । 


 স্টেপ ওয়াল 


 একটা কথা না বললে অনেক কথাই বলা হয় না । রানী কা ভাভ দেখতে এসে পাটোলা শাড়ির কথা না বল্লে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায় । কোথা থেকে এলো এই পাটোলা শাড়ি ? সোলাঙ্কির রাজারা  ৮০০ বছর আগে নাকি সৌরাষ্ট্র থেকে  শাড়ির বোনার শিল্পীদের এনেছিলেন । কেন? না  রানীর শাড়ি তৈরির জন্য। রানীর শাড়ি তৈরি করতে এসে তারা থেকে গেলেন পাটানে। । এঁদের শাড়ির নাম হলো পাটোলা । তাঁতিদের  পদবী থেকে শাড়ির নাম হল পাটোলা । শোনা যায়  ৭০০ বংশধর মিলে সারা বিশ্বের বাজারে পাটোলা শাড়ি পাঠানোই  ছিল এদেরপারিবারিক ব্যবসা । সব চেয়ে মজার কথা রানি কা ভাভে যে জাফরি কাজ গুলো আছে সেগুলোই শাড়ির প্রিন্টে বা সুতোর কাজে দেখতে পাওয়া যায় । এখানে কিছু দোকান আছে পাটোলা শাড়ির। ভারতীয় শিল্পকলাকে এবং অসাধারণ ভাস্কর্যের সম্মান জানাতে ১০০ টাকার নোটে ছাপা  হয়েছে রাণী কী ভাভ।

 ১০০ টাকার নতুন নোটে এই ছবিটি আছে। 

কি করে যাবেন :  ভারতের যেকোনো প্রান্ত থেকে বিমানে বা রেলে  যুক্ত আছে আমেদাবাদ। আমেদাবাদ থেকে প্রায় ১৪০ কিলোমিটার দূরে  রাণী কী ভাভ। এর জন্য আপনাকে গাড়ি নিতে হবে। সরকারি বাস যাচ্ছে মাহেসানা পর্যন্ত। এখান থেকে গাড়িবদল করে আপনাকে যেতে হবে রানী রাণী কী ভাভ। প্রাইভেট গাড়িও প্রচুর পাওয়া যায় ।  ভাড়া  ৪০০০ টাকা আসা যাওয়া। রাণী কী ভাভ দেখে  চলে যান মধে রাতে সূর্য মন্দির দেখে আসুন। একই দিনে দুটো হয়ে যায়।


মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ একটি লেখা। ইতিহাস আর ভ্রমণ দুটো একাকার হয়ে গেছে। খুব ভালো লাগলো। আমরা এরকমই ভ্রমণ কাহিনী পড়তে চাই।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।যাওয়ার ইচ্ছে রইল।

    উত্তরমুছুন
  3. পড়ে সমৃদ্ধ হলাম, খুব ভালো হয়েছে লেখাটা।

    উত্তরমুছুন
  4. উত্তরগুলি
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য। খুব খুব ভালো থাকুন।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রামায়ণের পথে শ্রীলঙ্কায় ভ্রমণ

কল্পা কিন্নর হিমাচল প্রদেশ

ইতালির কলোসিয়াম