ছবিমুড়া ত্রিপুরার আমাজন
ছবিমুড়া_ত্রিপুরার_আমাজন
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়
আগের দিন ঊনকোটি থেকে ফেরার সময় রাত হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় কুয়াশা ঢাকা গভীর জঙ্গলের গাছগুলো মাথা নুইয়ে ছিল রাস্তার দুই ধারে। এই পচা মে মাসে এমন কুয়াশা দেখে যেমন আনন্দ হচ্ছিলো তেমনি ভয়ও ছিল মনে। বৃষ্টিতে লাল কাদামাটি জড়িয়ে যাচ্ছিল গাড়ির চাকায়। তার ওপরে নিকষ অন্ধকার।আমাদের মাথায় কখন যে কুয়াশা ঢুকে পড়েছে আমরা নিজেরাও জানিনা। কাল আমরা যাব ছবিমুড়া।
সোমনাথদা হন হন করে হেঁটে যাচ্ছেন চায়ের খোঁজে। আমি তার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। হোটেল থেকে জানিয়ে দিয়েছে সকাল আটটার আগে চা হবে না। ত্রিপুরায় সকাল হয় একটু দেরিতে। দোকানপাট নটার আগে খোলে না। আর রাত আটটা হলে নিস্তব্ধতার আঁকি-বুকি। তাকে পেলে বাড়ি যাবো। সেরকমই চা পেলে তবেই ছবিমুড়া যাব। সবাই রাগারাগি করছেন , দেরি হয়ে যাচ্ছে দেরি হয়ে যাচ্ছে। সোমনাথ দা বলে এই তো হয়ে গেছে চলুন। ভাবি কিসের দেরি? আমরা তো দেরি করার জন্যই বাড়ি থেকে বেরিয়েছি !
ছবিমুড়া নামটার সাথে একটি শিল্প জড়িয়ে আছে। নামটা শুনলেই একটা ছবি ছবি ভাব মাথার ভিতরে হোঁচট খায়। কোন ছবিওলা মানুষ ওখানে নেই তো? ক্লান্ত অলস অবসর। সোজা বাসে বসে পরলাম ।চলো যাহা খেলে বোচাবুচি চল হুয়া দেখি যাই। রাস্তা কম নয়। আগরতলা থেকে প্রায় ৯০ কিমি দূর। অমরপুর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পরই রাজখাং এলাকার গোমতী নদীতে ‘ছবিমুড়া’ নৌকা ঘাট। সেখান থেকে নৌকায় যেতে হয় ছবিমুড়ার শিল্পকর্ম দেখছে।
জল ও জঙ্গল নিয়ে জাঙ্গাল বাঙ্গাল ত্রিপুরী দেশের এক গৈ-গাঁয়ের নদী দেখতে যাচ্ছি। নদীটা কেমন? বাপ নেই ভাববে, মা নেই কাঁদবে। গাঁয়ের পরিসীমার সঙ্গে সম আয়ত তার মনের বিস্তার। গ্রামের মধ্যে গাঁ, বড়ো গ্রামের অংশ ছোটো গ্রাম ছবিমুড়া। বাউল পীরের গানে-গানে ছড়ানো, কথক-পাঠকের মুখে-মুখে রঙানো ধর্ম-দর্শন ন্যায়-নীতির প্রবেশ হয়নি তাঁদের মনের সীমায়। খাড়া পাহাড়ে বুকে লাফ দিয়ে মানুষ গুলো কেটে আনে বড় একটা তলডা বাঁশ। এ যেন হলিউডের সিনেমা!
নদীর ঘাটের কাছে নৌকা বাঁধা আছে l আমরা সেই নৌকায় পা রাখি। দেখতে যাব ছবিমুড়ার ছবিকে। জলের রং ঘোলা। হবেনা কেন কাল রাতে অসম্ভব বৃষ্টি হয়েছে। খোয়াইয়ের মাটি গলে গোমতীর সাথে মিশে গেছে। আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বলে এসেছিলাম এবার তোমার জন্য নদী কিনে নিয়ে যাব। অনেকেই বলেন গোমতী নাকি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। বাংলাদেশ থেকে যদি আসে তাহলে আমি কিনবো কি করে? খোঁজ নিয়ে জানলাম : না না,সে আমাদেরই ছোট নদী। গোমতী ত্রিপুরার উত্তর-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের ডুমুর থেকে উৎপন্ন হয়ে পার্বত্যভূমির মধ্য দিয়ে সর্পিল পথে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার অতিক্রম করে কুমিল্লা গিয়ে পরেছে।
নৌকা ঘাটে নেমে একটা প্রাচীরের গন্ধ পাচ্ছি। একটা অন্যরকম বাতাস পাচ্ছি। নদীর তীব্র স্রোতে পাচ্ছি। কোন দেশে এলাম! নদীটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ভেসে উঠতে পারে একটা অ্যানাকন্ডা। এ কি আফ্রিকা!! এতোটুকু বানিয়ে বলবো না এ যেন ভারতের আমাজন।
বড় বড় গাছ নদী তাকে ঢেকে রাখতে চাইছে। বাঁশ গাছের পাতায় হাওয়া লাগছে। আর সুর ভেসে উঠছে। পাখির কলতান , বাতাস গাছের মধ্য দিয়ে চলে যায়, প্রাকৃতিক ঝর্ণার শব্দ, নদীর জলের শব্দ, নৌকার শব্দ সব মিলে মিশে জঙ্গলে বন্য পশুর শব্দমনে হবে। মনে হয় প্রকৃতির সাথে খুব কাছ থেকে কথা বলা। নদী এখানে সোজা সরল নয় বড় আঁকাবাঁকা। প্রতিটি বাঁকে যেন লুকিয়ে আছে ভ্রমণের আশ্চর্য রূপ লোক।
প্রাচীনকাল থেকে জমাতিয়া উপজাতি সম্প্রদায়ের বসবাস এখানে। জমাতিয়া লোককথা অনুসারে ছবিমুড়া হলো রুদ্রভৈরবী দেবীর স্থান। রাজা চিচিংফার প্রপিতামহ’র রাজত্বকালে তৈরি হয় দেবতামুড়া পাহাড়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলা গোমতী নদীর তীরের গায়ে খোদাই করা শিল্পকর্ম। শিলা খোদাই করা মা দুর্গার সবচেয়ে বড় মূর্তি প্রায় ২০ ফুট উঁচু। খোদাই করা ছবিগুলি ১৫-১৬ শতাব্দীর।দেবীর প্রতীমা প্রায় ২০ ফুট উঁচু, যা উপজাতিদের কাছে চাকরাখমা দেবী বলে পরিচিত। এই প্রতিমার মোট ১০টি হাত, তাই দেখতে কিছুটা দুর্গাদেবীর মতো। মাথায় রয়েছে অসংখ্য সাপ। দেবীর পায়ের নিচে আরেকটি প্রতিমা আছে। গবেষকরা একে দেবাদীদেব শিব বলে মনে করছেন। প্রতিমার নিচের স্তরে রয়েছে খোদাই করা সাপের ছবি। দেখে মনে হচ্ছিল দক্ষিণ ভারতের শিল্পকলার সাথে একটা মিল আছে। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় কিরকম উঁচু পাহাড়ের গায়ে কোন রদ্যা বা শঙ্খ চৌধুরীরা এসেছিলেন!
সুন্দর চিত্রগুলি দেবতামুরার পাথুরে মুখগুলিতে অনেক দক্ষতার সাথে বাঁকানো হয়েছে যা নব্বই ডিগ্রিতে খাড়া। পাহাড়ি পর্বতগুলি ঘন জঙ্গলে আবৃত এবং এই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ট্রেক করার পরেই দেবতাদের এই আবাসে পৌঁছানো যায়।
দেবতার আবাস!চলো হুহা দেখি যাই। একটা ছোট্ট জলা ঘাটের কাছে আমাদের নৌকা ভিড়লো। পিছিল তিন ফুটের রাস্তা সাপের মতো চলে গেছে জঙ্গলের ভিতরে। তির তির করে একটা লিকলিকে জলধারা নেমে আসছে পাহাড় থেকে। কথা বললেই ভেঙে যায় স্তব্ধতা। বড় বড় ফারের জঙ্গল, জঙ্গল থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। কোথায় যেনো পড়ে ছিলাম : ' মানুষের ভাষা মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কীটপতঙ্গ পশুপাখি প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি।'এখানে এসে মনে হচ্ছে প্রকৃতি কিছু বলতে চায়। আমিও কিছু বলতে চাই প্রকৃতিকে। বলি প্রকৃতিকে : এতো একা কেন তুমি? আদিম লতাগুল্মময় মিশিয়ে দাও না আমার শরীরে।
ঘোর কাটে। দাঁড়িয়ে পড়ি। সামনে লাল সাদা সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে জল ঝরনার মত। এই সিঁড়ি পেরিয়ে যেতে হবে দেবতাদের গুহায়। সেখানে নাকি লুকোনো আছে অনেক ধন সম্পত্তি। আমার ধন সম্পত্তি পাওয়ার লোভ নেই। গুহা দেখার লোভ আছে। অ্যানাকোন্ডার লুকিয়ে থাকার ভয়ও আছে। গুহার সামনে আসি। একটা বুনো গন্ধ নাকে আসে। গুহার সামনে জলও আছে। আমাদের সুব্রতদা সেই জলে চিংড়ি মাছ দেখেছিলেন। পার্থ দা,মৌসুমী,মতি, দেবাংশু, সোমনাথ দা, অনন্যা দি সবাই গুহা দেখে চলে গেছে, আমি একা। দূরে দেখি মাঝি এক লাফে বাঁশ গাছ ধরে ঝুলে পড়লো। ভয়ে আঁতকে উঠি। তর তর করে নামতে থাকি, নৌকা ঘাটে বাঁধা আছে।
Asadharon akti lekha.
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনDarun
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ
মুছুনযদিও ত্রিপুরা দুইবার গেছি কিন্তু উনোকোটি যাওয়া সত্বেও ছবিমুড়া যায়নি। নাম কিন্তু শুনেছি। আপনার লেখা যাওয়ার খিদেটা বাড়িয়ে দিল।
উত্তরমুছুনআবার গেলে অবশ্যই যাবেন
মুছুনDarun lagche
উত্তরমুছুনThanks
মুছুনঅপূর্ব লেখনী
উত্তরমুছুনঅনেক অনেক ধন্যবাদ
মুছুনছবি ও লেখা দুটোই অসাধারণ
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ
মুছুন